১৭০
আহমদ ছফার লেখা পড়েছি পরে।
আগে পড়েছি তাকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের বয়ান-
. . .“‘আমি আমার যৌবনে হন্টন পীরের মতো একজনকে পেয়েছিলাম।
আমরা দল বেঁধে তাঁর পেছনে হাঁটতাম।
তিনি যদি কিছু বলতেন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবেগে
অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করতেন “আমার বাংলাদেশ।
আমার বাংলাদেশ।”
আমরা গভীর মুগ্ধতায় তাঁর আবেগ
এবং
উচ্ছ্বাস দেখতাম।
তাঁর নাম আহমদ ছফা।
আমাদের সবার ছফা ভাই।” . . .
হুমায়ূনের একাধিক লেখায় আহমদ ছফা প্রসঙ্গ এসেছে।
তার
“নন্দিত নরকে”
প্রকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন এই মানুষ।
৭২-৭৫ এ মুজিব শাসন আমলে রক্ষী বাহিনী ছিল এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম।
মুক্তিযুদ্ধে বাবাসহ অনেক কিছু হারানো হুমায়ূন পরিবারকে
ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি বাড়ি বরাদ্দ দেয় সরকার।
এক রাতে রক্ষী বাহিনী এখানে হানা দেয়।
রত্নগর্ভা মা শহীদ জায়া আয়েশা ফয়েজসহ পুরো পরিবারটিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।
রাস্তায় রাত কাটে তাদের।
পরদিন সকালে হাজির হন আহমদ ছফা।
তার হাতে কেরোসিনের টিন। তিনি হুমায়ূন আহমেদকে বলেন যে, রিকশায় উঠুন।
গণভবনে যাব।
হতচকিত হুমায়ূন আহমেদ জানতে চান, কেন ছফা ভাই? উত্তরে ছফা বলেন,
শহীদ পরিবারকে অপমান করা হয়েছে।
আমি গণভবনের সামনে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করব।
এখানে কেরোসিন আছে।
আপনি আমার চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দেবেন।
হুমায়ূন আহমেদ আঁতকে ওঠেন।
তিনি দ্রুত বিভিন্নজনের সাথে আহমদ ছফার এ পরিকল্পনার কথা বলেন।
শেষে বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে এর মীমাংসা হয়। রক্ষী বাহিনীর অফিসার বাসা ছেড়ে দেয়।
হুমায়ূন পরিবার ঘরে ফিরতে পারেন।
আহমদ ছফাও আত্মহনন থেকে ফিরে আসেন।
এমন বিস্ময়কর মানুষ সম্পর্কে কৌতূহল জাগে।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে প্রথম পড়ি আহমদ ছফার ৫টি উপন্যাস সমগ্র।
ব্যাপক আলোড়িত হই।
উনার গদ্য সহজ।
হিউমার লেভেল চরমে।
বিষয়বস্তু অভিনব।
সব মিলিয়ে তিনি অত্যন্ত শক্তিমান লেখক।
কিন্তু অবাক বিষয় তাকে নিয়ে আলোচনা কম।
লাইব্রেরির বই নেওয়ার কার্ডে দেখি আমার আগে উপন্যাস সমগ্রটি নিয়েছেন মাত্র ৪ জন।
তার নন-ফিকশন লেখার মধ্যে প্রথম পড়ি
“বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস”।
এ বই নিয়ে আমাদের সংগঠনের পাঠচক্রও হয়।
“বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস”
– এর অল্প কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি।
যাতে স্পষ্ট হয় কেন আহমদ ছফা এই পা-চাটা সময়ে প্রায় আলোচনাহীন।
কোনো মিডিয়ার সাধ্য নেই তাকে ধারনের।
. . .“বর্তমান মুহূর্তে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরাই হচ্ছেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রেণি।
এরা চিরদিন হুকুম তামিল করতেই অভ্যস্ত।
প্রবৃত্তিগত কারণে তারা ফ্যাসিস্ট সরকারকেই কামনা করে।
কেননা একমাত্র ফ্যাসিস্ট সরকারই কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী সম্মান শিরোপা দিয়ে পুষে থাকে।
অল্পসংখ্যক বাছাই করা লোককে দিয়ে নিজেদের প্রচার প্রোপাগান্ডা
করিয়ে দেশের জনসমাজের স্বাধীন চিন্তা
এবং প্রাণস্পন্দন রুদ্ধ করেই ফ্যাসিবাদ সমাজে শক্ত হয়ে বসে।
চিন্তাশূন্যতা
এবং
কল্পনাশূন্য আস্ফালনই হল ফ্যাসিবাদের চারিত্র্য লক্ষণ।”
. . .(১৯৭২)
৭২ এর এমন লেখা থেকে ২০২২ এর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র বেশি পাল্টায়নি।
বদলও হয়নি কর্ততৃময় ক্ষমতা কাঠামো।
আহমদ ছফার জীবন ছিল ৫৮ বছরের।
এর মধ্যে তার প্রতিটি সৃষ্টি জাতির আগামীর পথচলার দিক নির্দেশনা দেয়।
জনপদে ধর্মান্ধতার বীজ চিহ্নিত করতে ফিরতে হবে তার
“বাঙালি মুসলমানের মন”- এ।
বাংলা ভাষা নিয়ে তার গবেষণা কর্ম ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক তার ভাবনা বহু বৈচিত্র্যের একটি দেশের সন্ধান দেয়।
শেখ মুজিব ও তার শাসন আমলকে তিনি চিত্রিত করেছেন মোসাহেবিপনার বাইরে থেকে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে তিনি দেখেছেন ভিন্ন চোখে। সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস নিয়ে তার লেখা অনন্য।
তার অনুবাদ কর্ম অসাধারণ।
শিশু ও কিশোর সাহিত্য বাল্যেই হৃদয় গড়ে দেওয়ার মতোন।
জাতির কাণ্ডারি রূপে তিনি সনাক্ত না করলে নিখোঁজই থাকতেন
প্রজ্ঞাময় জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক।
বিশ্ব কবি গ্যোতে অনুবাদহীন নিখোঁজ থাকতেন এক ছফা ছাড়া।
ছফাহীনতায় একজন দুনিয়া কাঁপানো এসএম সুলতান নড়াইলে লাল মিয়া হয়েই পড়ে থাকতেন।
আহমদ ছফার উপন্যাসে গৌরবের ৫২ আছে। একাত্তরের অন্য পাঠ পড়ি তার
‘অলাতচক্র’ এ।
স্রেফ দালালি করে কীভাবে ক্ষমতার কেন্দ্র দখল করে রাজনীতিবিদরা তার নজির
‘একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন’।
তার
‘গাভী বিত্তান্ত’
পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদধারীদের চরিত্র পরিস্কার হয়।
‘পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ’
বাংলা সাহিত্যে প্রাণ প্রকৃতি মানুষের মেলবন্ধনের এক নতুন দিশা দেয়।
চিন্তক, দার্শনিক, কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদ, সংগঠক ও জনবুদ্ধিজীবী
আহমদ ছফাকে কারও সাধ্য নেই লুকিয়ে রাখবার।
তার সৃষ্টিকর্ম দিনে দিনে বিস্তৃত হচ্ছে।
এখনের প্রয়াণ
বার্ষিকী ক্ষণ যেন তার
‘জল্লাদ সময়’
কবিতার এই পঙতিগুলোরই সাক্ষ্য দেয়।
. . .“সূর্যালোকে পিঠ দেয়া আততায়ী লজ্জিত সময়
যা কিছু প্রকাশ্য তুমি বামহস্তে করছ গোপন
সমূহ ধ্বংসের বীজ গর্ভাশয়ে করেছ রোপণ
কিছু কিছু সত্য আছে কোনদিন লুকোবার নয়।”
(নোটঃ
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
এর
সিলসিলা
এখনো বিদ্যমান!
আহমদ ছফা
হয়ে
হাল আমলের
খলিফা
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।
তো,
খান সাহেবের
সোহবতে
থাকলে
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
ও
আহমদ ছফা
চিন্তার
সবকাদি
পাওয়া যায়!)