“সিরাজ সিকদার আজ আর কোনো ব্যক্তির নাম নয়। সিরাজ সিকদার একটি সংকল্পের, একটি সংগ্রামের, একটি আদর্শের, একটি লক্ষ্যের ও একটি ইতিহাসের অধ্যায়ের নাম।”
বৃহস্পতিবার—১৯৭৫।
ইংরেজি নববর্ষের দ্বিতীয় দিন।
ওইদিন রাতে (২ জানুয়ারি)
‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ প্রধান নেতা সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদার তৎকালীন সরকারের রক্ষীবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। এর আগের দিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার হন সিরাজ সিকদার। গ্রেফতারের পর ওইদিনই তাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে সংঘটিত
প্রথম আলোচিত ক্রসফায়ারের ওই ঘটনার বিবরণ পুলিশের প্রেসনোটের উদ্ধৃতি দিয়ে ছাপা হয় সেই সময়ের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরাজ সিকদার গ্রেফতার হওয়ার পর তার পার্টি-কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাদের বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে নিয়ে যেতে রাজি হন। সে অনুযায়ী ২ জানুয়ারি রাতে একটি পুলিশ ভ্যানে তাকে ওইসব আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাভারের তালবাগ এলাকায় ভ্যান থেকে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন।
এ সময় পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে তৎক্ষনাত ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু আসলে কি ঘটেছিল সেদিন। ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা গণভবনে শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়।
সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীসহ আসামিরা, শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল এবং ভাগ্নে শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন। সে সময় রক্ষীবাহিনীর মাহবুব উদ্দিন তার রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। এরপর সেই আহত সিরাজ সিকদারের উপর শেখ মুজিবও নিজে নির্যাতন চালায়। মারধর করেন শেখ কামাল-মনিও। এরপর শেখ মুজিব ও মনসুর আলী সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং মাহবুব উদ্দিন আহমদকে নির্দেশ দেন। মাহবুব উদ্দিন আহমদ তার বাহিনীর লোকজনকে সঙ্গে বন্দী সিরাজ সিকদারকে শেরেবাংলানগর রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যান।
সেখানে তার ওপর আরও নির্যাতন চালানো হয় এবং ২ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দী অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।
শেখ মুজিবের আমলে এটা ছিল অন্যতম আলোচিত মিথ্যা রাজনৈতিক ক্রসফায়ার। অনেকের মতে, এটাই ছিল প্রথম রাজনৈতিক ক্রসফায়ার। কারণ শেখ মুজিবের ভারতপন্থী আচরণের কট্টর বিরোধীতা করেছিলেন সিরাজ সিকদার ও তার পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।
যেটা শেখ মুজিব বা তার সাঙ্গো-পাঙ্গোরা ভালোভাবে নিয়েছিলেন না। শেখ হাসিনার মতই প্রচন্ড অহংকার ছিল পুরো শেখ পরিবারের। ভিন্নমত এরা কখনই সহ্য করতে পারে নাই। প্রয়াত বুদ্ধিজীবী ড. আহমদ শরীফ ‘বিপ্লবী বীর সিরাজ সিকদার প্রসঙ্গে’ শিরোনামে এক লেখায় বলেন, “সিরাজ সিকদার আজ আর কোনো ব্যক্তির নাম নয়। সিরাজ সিকদার একটি সংকল্পের, একটি সংগ্রামের, একটি আদর্শের, একটি লক্ষ্যের ও একটি ইতিহাসের অধ্যায়ের নাম। এ মানবতাবাদী সাম্যবাদী নেতাকে হাতে পেয়ে যেদিন প্রচণ্ড প্রতাপ শঙ্কিত সরকার বিনা বিচারে খুন করল, সেদিন ভীতসন্ত্রস্ত আমরা তার জন্য প্রকাশ্যে আহা শব্দটি উচ্চারণ করতেও সাহস পাইনি। সেই গ্লানিবোধ এখনও কাঁটার মতো বুকে বিঁধে।”
মাহমুদুর রহমান মান্না ‘খবরের কাগজ’-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লেখেন, ‘সিরাজ সিকদার একজন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন সংগঠক ছিলেন। আমি যদ্দূর জানি, একথা তার ঘোর সমালোচকরাও স্বীকার করেছেন। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর ঘটনাটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে—ইতিহাসের একটি বর্বরতম ঘটনা। আমরা মধ্যযুগ কিংবা হিটলার মুসোলিনির আমলে এ ধরনের বর্বরতম ঘটনার নিদর্শন পাই। বুর্জোয়া যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলে থাকে আজকাল, এমনকি আমাদের দেশেও, তাতে সিরাজ সিকদার অপরাধ করে থাকলেও তার বিচার পাবার দাবি তো উপেক্ষিত হতে পারে না। সিরাজ সিকদার যে বিচারবঞ্চিত হয়েছিলেন, সরকারি প্রেসনোটে তখন যা উল্লেখ করা হয়েছিল (জিপ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে তিনি নিহত হন) তা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। একথা যারা এ প্রেসনোট নিয়েছিলেন তারাও স্বীকার করবেন। আর সবচেয়ে ন্যক্কারজনক হলো সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উল্লসিত আস্ফাালন—কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’
নতুন প্রজন্মের কাছে সিরাজ সিকদারকে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচয় করাইছে আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা। অথচ অনেকেই জানে না সিরাজ সিকদার ও তার সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রথম থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের আগেই সিরাজ সিকদার স্বাধীনতার কথা বলেছিল। ১৯৭১ সালের ৩ জুন বরিশালের স্বরূপকাঠির পেয়ারাবাগানে অনুষ্ঠিত এক গোপন সম্মেলনে সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন বিলুপ্ত করে গঠন করেছিলেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। টাঙ্গাইল, বরিশাল, মাদারীপুর, গৌড়নদী ও মঠবাড়িয়া অঞ্চলে দলটি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের ভুল ভারত নীতি ও ব্যর্থ দেশ পরিচালনার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় এই পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। মানে হল এইসব ফেক ক্রসফায়ার শেখ হাসিনার রক্তেই আছে। ভিন্নমত তার পরিবারের কেউ কখনই সহ্য করতে পারে নাই।