৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

“খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়ান!”-ড. জাহাঙ্গীর আলম

কর্তৃক Raju Ahmed Boni

Raju Ahmed Boni

কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য একমাত্র অবলম্বন কৃষি খাত। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১২ শতাংশ। মোট রফতানিতে কৃষিজাত পণ্যের শরিকানা প্রায় ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে হিমায়িত মৎস্য ও পাটজাত দ্রব্য যোগ করা হলে মোট রফতানিতে কৃষির হিস্যা প্রায় ৭ শতাংশ। এখনো দেশের শতকরা প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক কৃষি খাতে নিয়োজিত। শিল্প ও সেবা খাতের অগ্রগতি বহুলাংশে নির্ভরশীল কৃষি খাতের অগ্রগতির ওপর। এ অবস্থায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও সার্বিক উন্নয়নের জন্য জাতীয় বিনিয়োগ বিবেচনায় কৃষি খাত অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অনুসারে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি সমস্যার সমাধান করতে হলে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৪-৫ শতাংশ। গত চার বছর এ খাতে অর্জিত গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক ৩ দশমিক ২ শতাংশ। এ হার বাড়ানো দরকার। নয়া বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি। কয়েক মাস ধরে এ হার ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। গত ১১ মাসে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে ৬-৭ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে হবে। নতুবা সার্বিক মূল্যস্ফীতির ঈপ্সিত লক্ষ্য ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন সম্ভব হবে না।

আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে সম্প্রতি অনেকটা ভাটা পড়েছে। ২০২২-২৩ সালে মোট উৎপাদন ছিল ৩৯০ লাখ টন। প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত তিন বছরের গড় প্রবৃদ্ধির হার হলো দশমিক ৫২ শতাংশ। এ সময় জনসংখ্যার গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে চালের উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে বড় ধরনের উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করতে পারেনি। সে কারণে এবং খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধির চাপে অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম বেড়েছে। তাতে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি তাড়িত মূল্যস্ফীতি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কারসাজিও জড়িত আছে। আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো ছাড়া চড়া মূল্যস্ফীতি ঠেকানো খুবই দুষ্কর। এ বছর বাংলাদেশ দীর্ঘ খরা অতিক্রম করেছে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঠের ফসল। এল নিনোর প্রভাবে এবার বিশ্বজুড়েই বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। ফিলিপাইন ও আফ্রিকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খরা ও প্রচণ্ড দাবদাহ। বর্তমানে চাল, চিনি, তেল ও গরুর মাংসের দাম এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। এসব পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দমিয়ে রাখা খুবই দুরূহ হবে। এক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধিই প্রধান শর্ত।

প্রায় এক যুগ ধরে জাতীয় বাজেটের আকার দ্রুত বেড়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মূল বাজেটের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ৪ দশমিক ৮৭ গুণ বেশি। সে তুলনায় কৃষি বাজেট বাড়েনি। এ সময়ে কৃষি বাজেট বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৮ গুণ।

আগামী অর্থবছরে কৃষিবিষয়ক পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এ টাকা মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এর মধ্যে শস্য কৃষি খাতের জন্য রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ২১৪ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। বাকি ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ, ভূমি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এটা অপ্রতুল। ফসল খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় কম। ভর্তুকি হ্রাস অযৌক্তিক। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নয়া বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের বরাদ্দ ৮ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ কমে গেছে।

এবার নয়া বাজেটে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা, যা গত বছরের মূল বাজেট থেকে ২৭২ কোটি টাকা কম। সংশোধিত বাজেট থেকে তা ৮ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা কম। আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেল ও কৃষিযন্ত্রের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বাড়বে। সেক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস অনাকাঙ্ক্ষিত। তাতে বিঘ্নিত হবে কৃষির উৎপাদন। খাদ্যের নিরাপত্তা ব্যাহত হবে। জার্মানির ”বন” থেকে প্রকাশিত “গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস -২০২৪” বাংলাদেশকে বিশ্বের প্রথম সারির খাদ্যনিরাপত্তাহীন ১০টি দেশের মধ্যে অষ্টম স্থানে রেখেছে। বিবিএসের তথ্য অনুসারে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার অভাব আছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক কমোডিটি আউটলুক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সংঘাত ও আবহাওয়ার বৈপরীত্যের কারণে আগামী দিনগুলোয় কৃষির উৎপাদন হ্রাস পাবে। খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য বাড়বে। তাতে দুর্ভোগ বাড়বে নিম্ন আয়ের মানুষের।

২০২২ সালের জুলাইয়ের পর ইউরিয়া ও ডিএপি সারের প্রতি কেজি দাম বাড়ানো হয়েছিল ১৬ টাকা থেকে যথাক্রমে ২৭ ও ২১ টাকা। টিএসপি ২২ থেকে ২৭ এবং এমওপি ১৫ থেকে ২০ টাকা। সম্প্রতি রাসায়নিক সারের দাম বিশ্ববাজারে প্রায় ৫২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সারের উচ্চ মূল্য এখনো বহাল রয়েছে। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ২০২২ সালের মধ্যভাগ থেকে পরপর দুবার সারের দাম বাড়ানো হয়েছিল অভ্যন্তরীণ বাজারে। এখন বিশ্ববাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে তা ২০২২ সালের প্রথমার্ধে প্রচলিত মূল্যসীমায় প্রত্যাবর্তন করেনি। সেচের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হয় সেচযন্ত্রে ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর। ডিজেলে কোনো ভর্তুকি নেই। অথচ দেশে পানি সেচ প্রদানের কাজে নিয়োজিত শতকরা প্রায় ৭০ শতাংশ সেচযন্ত্রই এখনো ডিজেল নির্ভর। কৃষিযন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে সরকার ৫০ শতাংশ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে থাকে। বর্তমানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেচ যন্ত্রের দাম টাকার অংকে অনেক বেড়ে গেছে। চলমান ভর্তুকিতে আগের তুলনায় অনেক বেশি টাকা খরচ করে কৃষিযন্ত্র কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না অনেক কৃষক। এক্ষেত্রে ভর্তুকি বাড়ানো দরকার।

নয়া বাজেটে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, তবে উন্নয়ন ব্যয় বেড়েছে। এ খাতে মোট বরাদ্দ ৬ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা, বেড়েছে ৬২২ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশে খাদ্যগুদামের ধারণক্ষমতা খুবই কম, ২১ দশমিক ৮৬ লাখ টন। নতুন অর্থবছরে তা ২৯ লাখ টনে উন্নীত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য সংরক্ষণ ক্ষমতা ৩৭ লাখ টনে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪৬৭ লাখ টন। এর ন্যূনতম ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ৪৭ লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন গুদাম শিগগির নির্মাণ করা প্রয়োজন।

নয়া বাজেটে ৩০টি প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা কিছুটা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। কর ও শুল্কহার কমিয়ে অতীতে পণ্যমূল্যের দাম সহনীয় করা সম্ভব হয়নি। কর ও শুল্কহার হ্রাসের কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারেনি দেশের দরিদ্র ভোক্তারা।

আমাদের মোট বাজেটের মাত্র ৩৬ শতাংশ ব্যয় হয় উন্নয়ন খাতে। বাকি ৬৪ শতাংশ ব্যয় হয় সরকার পরিচালন খাতে। ভবিষ্যতে পরিচালন ব্যয় কমিয়ে উন্নয়ন ব্যয় বাড়াতে হবে। তাতে বরাদ্দকৃত খরচের আর্থিক প্রতিদান বাড়বে। নিশ্চিত হবে জনকল্যাণ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রথম চার বছর মোট বাজেট বরাদ্দের অর্ধেকেরও বেশি বরাদ্দ নিশ্চিত করেছিল উন্নয়ন খাতে। এরপর ক্রমাগতভাবে সেই হিস্যা হ্রাস পেয়েছে। ভবিষ্যতে তা বাড়ানো দরকার। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য প্রণীত বাজেটে কৃষি উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ২০ শতাংশ অর্থ। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৭ শতাংশে। এ হার বাড়াতে হবে।

আমাদের রফতানি পণ্য পাট, চামড়া ও শাকসবজি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রতিকার দরকার। এর কারণগুলো চিহ্নিত করে সমস্যা দূরীকরণের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য কমিশন গঠন করা খুবই প্রয়োজন। এক দশক ধরে কৃষি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে গড়ে প্রায় ৮ শতাংশ হারে। কিন্তু তাতে প্রান্তিক ও বর্গাচাষীদের অন্তর্ভুক্তি বাড়েনি। এখনো প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষক প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের আওতাবহির্ভূত। এদের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। কৃষি বীমা চালু ও দুর্যোগ মোকাবেলা তহবিল গঠন করা প্রয়োজন কৃষি খাতের জন্য।

কৃষির বিভিন্ন উপখাতে ক্রমাগতই উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন ও সবার জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত এবং তা টেকসই করতে হলে এ প্রবৃদ্ধির হার আরো গতিশীল করতে হবে। সে কারণে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।

written by-  ড. জাহাঙ্গীর আলম

কৃষি অর্থনীতিবিদ; পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস ও সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ । এবং গবেষণায় একুশে পদকপ্রাপ্ত (২০২০)

আস্থা লাইফ ইন্সুইরেন্স কোম্পানী লিমিটেড" (গাংনী শাখা, মেহেরপুর।) Hotline --01532232681

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.