২১৩
Raju Ahmed Boni
কোটা-সংস্কারের শান্তিপূর্ণ শিক্ষার্থী আন্দোলনের ওপর গুলি চালিয়ে আবারও রক্তাক্ত করা হলো বাংলাদেশকে।
মিডিয়ার বরাতে জানা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৬ জন শিক্ষার্থী আন্দোলনকারী। দেশব্যাপী আহত হয়েছেন হাজারখানেক শিক্ষার্থী।
গত ১৫ জুলাই দিনভর ও ১৬ জুলাই প্রথম প্রহরে ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডা ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নামিয়ে দিয়ে নিজেদের শিক্ষার্থীদের ওপর নারকীয়, ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক হামলা চালানো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে। এরপর ১৬ জুলাই দিনভর পুলিশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলা চলেছে দেশব্যাপী এবং সেই হামলা আগের দিনের তীব্রতাকে হার মানিয়ে হত্যাকাণ্ডের মতো ক্ষমার অযোগ্য বর্বর ঘটনার জন্ম দিয়েছে।
গত দুই দিনে ক্যাম্পাসগুলোয় যা ঘটেছে, নারী শিক্ষার্থীদের ওপর যে ভয়াবহ আক্রমণ হয়েছে তাতে বোঝা যায় যে সরকার কতটা নারী অবান্ধব। এসব ন্যাক্কারজনক হামলার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনকে যেভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে, তা আমাদেরকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমরা গভীর উদ্বেগ ও বেদনার সঙ্গে এসব হত্যাকাণ্ড ও হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং নিহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। একইসঙ্গে, এসব হত্যাকাণ্ড ও হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।
এছাড়া, সন্ত্রাসীদের হামলায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষকও শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসকেরা নীরবে এই সব ন্যাক্কারজনক হামলা এবং নিজ শিক্ষার্থীদের রক্তপাতকে বৈধতা দিয়েছেন এবং এই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে রক্তপাতের অংশীদার হয়েছেন শুধুই পদপদবি আঁকড়ে রাখার জন্য। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব লজ্জাহীন প্রশাসকদের আমরা ধিক্কার জানাই।
আমরা মনে করি,
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের দাবি কোটা শতকরা ৫৬ ভাগ থেকে কমিয়ে আনার যৌক্তিকতা ছিল। এই ন্যায্য ও যৌক্তিক আন্দোলন থেকে উত্থাপিত দাবি বিবেচনা না করে সরকার পরিকল্পিতভাবেই প্রথমত উপেক্ষা ও দ্বিতীয়ত দমন ও নিপীড়নের নীতি গ্রহণ করেছিল । অবশেষে আন্দোলন তীব্র হলে, প্রধানমন্ত্রী ‘বিরক্ত হয়ে’ কোটা প্রথা বাতিল করে দেন। আমরা মনে করি, সেটা একটা বিভ্রান্তিকর এবং চাতুর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ নারী এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনার জন্য কোটার প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু তা চলমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে যৌক্তিকভাবে সংস্কার করা প্রয়োজন ছিল।
সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করা একটি রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট ‘সংবিধান পরিপন্থী’ বিবেচনা করে ২০১৮ সালের পরিপত্রকে বাতিল করার রায় দিয়েছেন। অর্থাৎ ৫৬% কোটার পরিস্থিতি আবার ফিরে আসে এবং চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলনে নামেন। এদিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেন। অর্থাৎ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাজপথ না ছেড়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে গেলেও, আগস্ট মাসে কোটাব্যবস্থার সংস্কারসহ যুক্তিযুক্ত সুরাহা হবার পথ তৈরি হয়েছিল, যা পরিহার করে সরকার যথারীতি শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বানিয়ে নির্যাতন আর নিপীড়নকেই বেছে নিল।
আমরা বিশ্বাস করি, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও সংগ্রাম ছাড়া আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেতাম না। তাদের এবং তাদের পরের প্রজন্মের জন্য কোটাও সে সময়ের জন্য সঠিক ছিল। কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মের জন্যও ওই কোটা একইভাবে রাখার প্রয়োজন নেই বিধায় এটি কমিয়ে আনা দরকার। এই বিষয়টিকেই সরকার ২০১৮ সালে এবং এ বছরও রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতায় রূপ দিয়েছে এবং আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার-সংশ্লিষ্ট’ বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তকমা দেবার চেষ্টা করেছে।
২০১৮ সালেও তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংসদে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীদের ’রাজাকারের বাচ্চা’ বলে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। এবারও প্রধানমন্ত্রী তাঁর গত ১৪ জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম বা নাতিপুতির বিপরীতে, পরোক্ষভাবে, আন্দোলনকারীদেরই ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে আন্দোলনকারীরা ”তুমি কে আমি কে/ রাজাকার রাজাকার/ কে বলেছে কে বলেছে/ স্বৈরাচার স্বৈরাচার”- স্লোগানসহ রাস্তায় নেমে আসে। দুর্ভাগ্যবশত এই স্লোগানকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে আন্দোলন দমনের জন্য সরকার উগ্র দলীয় কর্মীদের উস্কে দেয়ার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করল। আর সেই ভুল ব্যাখ্যার ফলাফল হলো– বাইনারিকরণের মাধ্যমে জাতিগত বিভেদ ও বিদ্বেষ এবং বিমানবিকীকরণ।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্ষমতায় বসে থাকা সরকার যেকোনো অধিকারসংক্রান্ত আন্দোলনকে সন্দেহের চোখে দেখে, এবং ব্যাপক নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তা সরকারবিরোধী জনবিক্ষোভে পরিণত হবার সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে নষ্ট করে দিতে চায়। দেশে ভয়াবহ লুণ্ঠন, সম্পদ পাচার, দুর্নীতি না থামিয়ে এদের বাড়তে দেয়া হয় কারণ এইসব লুণ্ঠনজীবিরাই সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতার পাহারাদার। অন্যদিকে দেশের রিজার্ভের ভয়াবহ অবনতি ও তা ঘোচাতে চীনের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়া এবং ভারতের রেল যোগাযোগ নিশ্চিত করতে গিয়ে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া বা ভারত তিস্তার ব্যরাজ খুলে দিয়ে পুরো উত্তরবঙ্গ প্লাবিত করার এই দুঃসময়ে দেশের শিক্ষিত যুবসমাজকে আন্দোলন এবং দমন-পীড়ন দিয়ে ব্যস্ত রাখাও তাদের কৌশলের অংশ। আমরা ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢাকার এরকম রাষ্ট্রীয় ও সরকারি অপতৎপরতার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
আমাদের দাবি:
১। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যারা হামলা করেছে, গুলি করেছে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
২। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে। সংবিধানের আলোকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে কোটা সংস্কারের রূপ নির্ধারণ করতে হবে।
৩। ছাত্রলীগ নামধারী বহিরাগত সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পাসে অনুপ্রবেশ ও ত্রাস সৃষ্টির ঘটনার প্রতি আমরা তীব্র নিন্দা জানাই এবং আর কোনো বহিরাগত যেন ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪। শিক্ষার্থীরা যাতে নিরাপদে ছাত্রাবাসে থাকতে পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।