১৯১
বাংলাদেশে এসেই অধ্যাপক ইউনূস এর দেয়া বক্তব্যের একটি অংশ শুনে
চমকে এবং খুব সামান্য পরিমানে আতকে গিয়েছিলাম।
তার চাইতেও বেশি আশাবাদী হয়েছিলাম,
জাতির এই দুর্যোগে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক তিনি হতে পারবেন।
সেটি নিয়ে একদম শেষে বলছি।
কিন্তু সেটার কথা আবার মনে পড়লো
সম্প্রতি মাযারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায়।
এটা সরকারে একটা বড় দুর্বলতার দিককে উন্মোচন করছে।
এখনই সতর্ক না হলে খুবই ভুল বার্তা যাবে, দেশে এবং বিদেশে।
আরও একটি বিষয়।
পতিত স্বৈরাচারের আমলে ছাত্রলীগের নেতাদের প্রায়ই বিবৃতি দিতে দেখতাম:
আমাদের নাম নিয়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে।
এতে করে কাদের নাম নিয়ে চাঁদাবাজি হয়,
সেটা সম্পর্কে সম্ভাব্য চাঁদাদাতারা নিয়মিত অবগত থাকতেন।
এই ঘটনা এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসে দখলদারি ও চাঁদাবাজির
উৎকৃষ্টতম সময় ৭২-৭৫ সম্পর্কে আরও প্রযোজ্য।
৭২-৭৫ এর সেই রকম সময় আর আসবে না,
কারণ সেটা ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন পরবর্তী
বিরাট একটি রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের সময়ও।
সেই সময়টাকে ব্যবহার করা যেতো দেশ পুনর্গঠন
কিংবা একচ্ছত্র দেশ দখল– দুটোর মাঝে কোন একটা কাজ করে।
সময়ের সেই কর্তব্যের মুখোমুখি হয়ে
শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার একটা বিপর্যয়কর পথ বেছে নিয়েছিলেন।
সেটা কী, তা নিয়ে অনেকবার লিখেছি অতীতে, ভবিষ্যতেও ইতিহাসের প্রয়োজনে আবার লেখা যাবে।
আপাতত বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার নিয়ে দুটো মন্তব্য দেয়া যাক।
এক.
অন্তবর্তীকালীন সরকার যদি জনগণের কাছে স্বচ্ছ
এবং দায়িত্বশীল ভাবমূর্তি রক্ষা করতে চায়,
তার পরিস্কার কর্তব্য হবে
পুলিশ, দুদক, বিচারবিভাগ, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করা।
এটার প্রক্রিয়া অবিলম্বে শুরু করতে হবে।
পুনর্গঠনের পর অবশ্যই তাদের ভুলশুদ্ধসহ স্বাধীনভাবেই কাজ করতে দিতে হবে।
এবং অবশ্যই,
সেগুলোকে কঠোর জবাবদিহিতা ও তদারকিতেও রাখতে হবে।
কিন্তু তদারকি মানেটা কী?
এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেনো সরকারের বাইরে কোন ব্যক্তি,
নেতা কিংবা গোষ্ঠীর চাপের মুখোমুখি না হয়,
সেটা নিশ্চিত করতেই হবে।
অর্থাৎ একথায়,
জবাবদিহিতায় আনতে হবে,
তেমনি তাকে চাপমুক্ত হয়ে কাজও করতে দিতে হবে।
কর্তব্য ও অধিকার দুটোই যেমন জরুরি যে কোন দায়িত্ব পালন করতে হলে।
এই চাপ থেকে তাদের মুক্ত হয়ে কাজ করার অধিকার নিশ্চিত না করতে পারা গেলে
দ্রুতই বিশৃঙ্খলা শুধু দেখা দেবে না,
দেশে তদবিরবাজি ও চাঁদাবাজির রাজত্বও শুরু হবে!
রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনের সময়ে
যদি কোন-না-কোন-ভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক বৈধভাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হননি,
এমন কাউকে লোকজনকে সেখানে নিয়মিত খবরদারি করতে দেয়া হয়,
স্বাধীনতার সাথে জবাবদিহিতার অধীনে থেকে
কাজ করতে পারার বদলে তারা ব্যবহৃত হতে শুরু করবে।
অনির্ধারিত ব্যক্তিদের বকাঝকা কিংবা এমনকি উপদেশ দেয়ার জন্য
প্রতিষ্ঠানগুলো অবারিত দ্বার থাকলে অতি দ্রুত এগুলো এমন মৎস্যন্যায়ের কবলে পরবে যে
(ব্যক্তিগতভাবে আমার বিবেচনায় প্রায় সর্বাংশে)
বাংলাদেশের ইতিহাসের দক্ষতম ও অভিজ্ঞতম উপদেষ্টা পর্ষদকেও
দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারে।
দুই.
জনগণকে বুঝিয়ে দিতে হবে,
অন্তবর্তীকালীন সরকার কার্যকরভাবেই দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থেই কারও
অনধিকারভুক্ত হস্তক্ষেপ এই সরকার গ্রহণযোগ্য বলে মনে করবে না।
অথবা, ঘোষণা করুন যে জনগণের কাছে
এখনও অস্পষ্ট ও অনেকটাই অপরিচিত একটা “সমন্বয়ক পরিষদ” দেশ চালাচ্ছে,
অন্তবর্তীকালীন সরকার সেই পরিষদের মুখপাত্র, কিংবা অধিনস্ত।
সেটাও খারাপ না।
বিপ্লবের সময়ে সেমনটি হতেও পারে।
কিন্তু, মানুষ কাদের কাছে তাদের নালিশ, আর্জি, বক্তব্য বা সুপারিশ জানাবে,
এবং কার বিরোধিতা করবে সেটা পরিস্কার হওয়াটা খুব জরুরি।
সরকারী ব্যক্তি কে কে,
রাষ্ট্র কাদেরকে দিয়ে পরিচালিত হয়,
সেটা নির্দিষ্ট না থাকলে মাযার ধ্বংস থেকে শুরু করে আগুন লাগা,
দখলদারি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে দুদকের মামলা প্রত্যাহার,
কোন কিছুর জন্যই কাকে দায়ী করা হবে,
সেটা আর নির্দিষ্ট থাকবে না।
অগাস্ট এর ঘটনাবলির সীমা একটা গণঅভ্যুত্থান ছিলো,
বিপ্লব নয়,
আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় তা স্পষ্ট।
কিন্তু সেটা অজস্র মানুষের বহু বছরের সাধনার ফল।
এখন খুবই শক্তিশালী কিছু পক্ষ,
কিছু গণমাধ্যম এটিকে কয়েকজন মানুষের প
রিকল্পিত কাজ হিসেবে দেখাতে চাইবে।
কারণ, কারও কারও জন্য এটা ক্ষমতা চর্চার জন্য,
ক্ষমতার কাছাকাছি যাবার জন্য সুবিধাজনক।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপেদেষ্টাদের প্রতিও তাই অনুরোধ থাকবে,
আপনাদের নিজেদের কর্তৃত্ব জনগণের সামনে আরও দৃশ্যমান করুন।
ব্যক্তিগতভাবে সকলকে না চিনলেও মোটা দাগে
এই উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি জনগণের সমর্থন এখনও পূর্ণাঙ্গ রয়েছে।
ইতিহাস এমন সুযোগ বারবার দেয় না।
গণঅভূত্থানকে বিপ্লব না হোক,
একটা সামাজিক রুপান্তরের লক্ষ্যে আরও যতদূর নেয়া সম্ভব,
আপনার যদি এগিয়ে যান, মানুষ সেই সমর্থন দেবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয়,
উপদেষ্টা পরিষদের সাথে সমন্বয়কদের সম্পর্ক কী,
তাদের ক্ষমতার ও অধিকারের সীমা কী,
সস্বয়করা কারা,
তাদের সকলের প্রতি জনসমর্থন সমান কিংবা প্রতিনিধিত্বমূলক কি না,
ইত্যাদি প্রশ্ন যে দারুণ রকম অস্পষ্ট,
সেটাই এখনকার খানিকটা হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ী।
এটা কাটবে না সহজে, বরং সামনের দিনে হয়তো বৃদ্ধি পাবে,
যদি বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে।
হয়তো ঘটনাবলির মধ্য দিয়েও সরকার নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করবে–
এমন আশাও ত্যাগ করছি না।
কারণ, আমি আশাবাদী,
অর্থনীতির হাল এই অন্তবর্তীকালীন সরকার ধরতে পারবেন।
ভারতের সাথে সম্পর্কের বেলায় তারা দৃঢ়তা দেখাতে সমর্থ হবেন।
ইতিমধ্যেই সেই ইঙ্গিতগুলো দেখা যাচ্ছে।
সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটিকেও তারা অসাধারণভাবে মোকাবেলা করেছে।
এটা ছিলো (এবং আছেও) নতুন সরকারের জন্য একটা বড় পরীক্ষা,
এই ক্ষেত্রে পা পিছলালে জনগণের
যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল অন্তবর্তীকালীন সরকার,
সেটাতে বড় আকারে ফাটল দেখা দিতো।
পতিত স্বৈরাচারের রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও লুটেরাদের বিচারের
একটা স্বচ্ছ ও ন্যায় সঙ্গত প্রক্রিয়াও তারা চালু করবেন,
এটাও আমাদের আশা।
যদিও যে মামলাগুলো দেয়া হয়েছে,
তা আমাদের কিছুটা হলেও হতাশ করেছে।
মানুষ খারাপ আশঙ্কা করছে।
বাহিনীগুলো পুনর্গঠন না হওয়াতে লেনদেনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
হতাশা যেখানে,
দেশের অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলার যে উন্নতি আশা করেছিলাম, তা হয়নি।
সত্যি যে,
শুরুতে পুরোটা ঠিক হয়ে যাবার আশা করাটা অন্যায়।
কিন্তু আদালত পাড়ায় হামলা থেকে শুরু করে
কারখানায় আগুন কিংবা মাযার ধ্বংস–
এগুলো নিয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ এখন গণমানুষের দাবি।
এই সব ক্ষেত্রে শুরুতেই সব ঠিক না করা গেলেও অন্তত শক্ত ভূমিকা গ্রহণ খুব জরুরি ছিলো।
শুরুর প্রসঙ্গেই আবার যাই।
বাংলাদেশে পা দিয়েই অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন
এমনকি কাদিয়ানী সম্প্রদায়েরও নাগরিক অধিকারের কথা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন সরকার প্রধান প্রকাশ্যে এই সাহস দেখাননি।
এ নিয়ে কট্টরপন্থীরা যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি,
সেটা জুলাই ঘটনাপ্রবাহে নতুন সরকারের প্রতি,
এবং অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিও শক্তিশালী একটি জাতীয় সমর্থনের ইঙ্গিত।
কাদিয়ানী বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূসের এই বক্তব্যকে পছন্দ না করা
রাজনৈতিক শক্তিগুলোও সেটাকে এড়িয়ে যাওয়াকে সুবিধাজনক মনে করেছে।
অথবা, এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
আমাদের প্রবল আশা,
অন্তবর্তীকালীন সরকারকে কার্যকর একটি সরকার হিসেবে
অধিষ্ঠিত করে মানুষের সেই সমর্থনের ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে
সংস্কারের কাজগুলোতে এগিয়ে যাবেন।
কিন্তু, সরকার যে কার্যকর কর্তৃত্বে আছে,
সেটা তাদেরকে কথা ও কাজে পরিস্কার করতে হবে।
অন্তত ওই দুটো বিষয়ে।
কেননা,
বিরোধিতা করতে হলেও আমরা সরকারেরই বিরোধিতা করতে চাই।
এই ক্ষেত্রে যেন কোন অস্পষ্টতা,
অনির্দিষ্টতা না থাকে।
লিখেছেন-
ফিরোজ আহমেদ
কেন্দ্রীয় সদস্য
গণসংহতি আন্দোলন।