গুলশানের “Holey Artisan Bakery” জঙ্গি হামলা, জিম্মি, হত্যাযজ্ঞ ও অপারেশন থান্ডারবোল্ট: আমার অভিজ্ঞতা ।
অপারেশন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার বুক ধরফর শুরু হলো। ঠিক ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। আশেপাশে আর কোনও সাংবাদিক চোখে পড়ছে না। কেবল একজন বিদেশী সাংবাদিক ছাড়া। গণমাধ্যমকর্মীদের সবাইকে অনেক দুরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি বিশেষ কৌশলে পরিচয় গোপন রেখে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সবাই অবস্থান করছেন, সেখানেই। তখন ৭ টা বেজে ২০ বা ২৫ মিনিট হবে। হঠাৎ করেই সেনাবাহিনীর একাধিক জিপ এসে মোড়টিতে দাঁড়ালো। ভেতর থেকে অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে কমান্ডোরা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তারা একসঙ্গে জড়ো হয়ে গেলেন। তাদের কমান্ডার একটা “শর্ট ব্রিফ” দিলেন। তারপর মুভ বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে ফুটপাতে ক্রলিং করে এগোতে থাকলেন। এক দলের পর আরেক দল। এর আগেই সাঁজোয়া যান এসে হাজির হয়েছে। হোলি আর্টিজানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কমান্ডোরা। কিছু দূর যাওয়ার পর আমার চোখের আড়াল হয়ে গেলো তারা। আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে, সেটা হোলি আর্টিজানের দিকে যেত সর্বশেষ যে মোড়, তার দক্ষিণ রাস্তার কর্ণারে। আমার বিপরীত দিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকতারা দাঁড়িয়ে। রাস্তার এপার-ওপার। আমার এপাশে গুটি কয়েক লোক। সবাই সাদা পোশাকে। এসবি, ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের গোয়েন্দা তারা। বুলেট প্রুফ জ্যাকেট নেই তাদের, আমারও। আমি তাদের সঙ্গে অনেকটা তাদের লোক হয়েই মিশে আছি।
৭ টা ৩৫ মিনিটে কয়েকজন জিম্মি বেড়িয়ে এলেন। নারী-পুরুষ-শিশু। অন্যদের মতো আমিও ভিডিও করলাম। ভয় লাগছিলো পাছে যদি ধরা পড়ে যাই। তাহলে আর কিছু হোক না হোক জায়গাটা হারাতে হবে আমাকে। অন্য গণমাধ্যমকর্মীদের মতো আমাকেও অনেক দুরের বেষ্টনীর বাইরে থাকতে হবে। কিন্তু ছবি বা ভিডিও অন্যরাও করছিলো, তাই আমিও করলাম। যদিও কমান্ডোরা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন আমার বুক উত্তেজনায় এমন ধরফড় করছিলো যে আমি মোবাইল ক্যামেরা কয়েকবার চালু করেছি আর বন্ধ করেছি। কিন্তু ছবি তোলা বা ভিডিও করতে পারিনি। সাহস হয়নি। তারপর শুরু হলো ঠা…ঠা…ঠা…ঠা… আওয়াজ। গুলির। গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলো। মাঝে মধ্যেই গ্রেণেড বিস্ফোরণের মতো বিকট আওয়াজ। কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। অন্যদের সঙ্গে আমিও উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। পেছনে থেকেই। সামনে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। শঙ্কা ছিলো যদি কেউ জিজ্ঞেস করে ‘এই, আপনি কে?’ তাহলেই শেষ। সাংবাদিক শুনলে ক্ষেপে যাবে। বের করে দিবে। অপমান বা গলাধাক্কাও দিতে পারে। একারণে ঝুঁকিটা নেইনি। অন্যান্য গোয়েন্দা সদস্যদের ঘারের ওপর দিয়ে যতটা দেখা যায়, তাই উঁকি-ঝুঁকি মারছি। আমার এই এতটা কাছ থেকে অপারেশন প্রত্যক্ষ করার কারণ আমার অদম্য কৌতুহল, একজন সাংবাদিক হিসেবে যা থাকাটা খুবই বাঞ্ছনীয়।
রাতে যখন গুলশানে গোলাগুলির খবর পেলাম অফিসে বসে, তখন তা এতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে কল্পনা করিনি। অফিসের এক কলিগকে খোঁজ নিতে বললাম। নিজেও চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনও পুলিশ কর্মকর্তাই ফোন ধরছেন না বা ব্যস্ত পাচ্ছি। থানা থেকে জানা গেলো বড় ঘটনা আশেপাশের সব থানার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গেছে। এর মধ্যেই এসবির এক কর্মকর্তাকে পেয়ে গেলাম ফোনে। তিনি আমাকে বরং একটু ধমকই দিলেন যে, এত বড় ঘটনা তবু ঘটনাস্থলে না গিয়ে তাকে ফোন করছি কেন? তিনি ঘটনাস্থলে। বুঝলাম বড় কিছু। তিনি অবশ্য প্রাথমিক কিছু তথ্য শেয়ার করলেন। তারপর অফিসে বড় কর্তাদের কাছে জানিয়ে ছুটলাম ঘটনাস্থলের দিকে। অফিসের নিচে এসেছিলো বন্ধু-সাংবাদিক সহকর্মী বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাখাওয়াত কাওসার। নিচে নামতেই সাকা বললো বড় ঘটনা চলেন যাই। আমরা ছুটলাম মোটরসাইকেলযোগে। দু’জনের দু বাইক। কারওয়ানবাজার থেকে গুলশানের শ্যুটিং ক্লাবের কাছে পৌঁছতেই বিশাল জ্যাম। বোঝা গেলো রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। কোনওরকমে উল্টো পথে এগিয়ে গেলাম। পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। আমাকেও যেতে দিবে না। আমি আমার দায়িত্বটা তাকে বোঝালাম। কিন্তু উর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া কাউকে গুলশানে ঢুকতে বা বেরোতে দিচ্ছে না তারা। পরে একজন উর্ধ্বতন এগিয়ে এলেন। তিনি আমার পরিচয় নিশ্চিত হলেন পরিচয়পত্র দেখে। তারপর সার্চ-টাচ করে ছাড়া পেলাম তাদের কাছ থেকে। বাইক নিয়ে এগিয়ে গেলাম ঘটনাস্থলের দিকে। স্পটে গিয়ে চোখ আমার ছানাবড়া। বিশাল ঘটনা। আমি আগে আঁচই করতে পারিনি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অসংখ্য সদস্য। চারদিকে। হোলি আর্টিজানের কাছাকাছি যেতেই দ্রুম…দ্রুম….. গুলি ও বোমার আওয়াজ। দেখা হলো সাকার সঙ্গে। ও আমার আগেই পৌঁছেছে। সে হাপাতে হাপাতে বললো…অল্পের জন্য বাঁচলাম। জঙ্গিরা গ্রেণেড মেরেছিলো। পুলিশের একটি দলের সঙ্গে সেও এগিয়ে গিয়েছিলো। এর মধ্যেই রক্তাক্ত কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া দেখলাম। একটু পর রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পেলাম ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মারুফ ভাইকে। তার গায়ে স্প্লিন্টার লেগেছে। তিনি জানালেন, ওসি সালাউদ্দিন অলরেডি ডেড। এরমধ্যে বিডিনিউজের লিটন ভাইসহ অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। নোট নেয়ার চেষ্টা করছি। তথ্য সংগ্রহ করছি। পুলিশ-র্যাব-সোয়াতের সদস্যরা প্রস্তুতি নিচ্ছে। একপাশে দেখলাম র্যাব-১ এর সিও তুহিন ভাই ফার্স্ট এইড নিচ্ছেন। পরিস্থতি ভয়ঙ্কর। থমথমে। জঙ্গিরা হামলা করেছে এক রেস্টুরেন্টে। জিম্মি করে রেখেছে দেশী-বিদেশী নাগরিকদের। ঢাকার ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। এরকম কোনও ঘটনাও আমি কাভার করিনি কখনো। একেবারে যুদ্ধের মতো অবস্থা। একটু পর দেখলাম সোয়াত প্রস্তুতি নিচ্ছে।
র্যাবের পক্ষ থেকে টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ বন্ধ এবং ক্যামেরা দুরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। সঙ্গে রিপোর্টারদেরও। বড় কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে কৌশল নির্ধারণ করছেন। সোয়াতের একটি টিমকে প্রস্তুতি নিতে দেখা গেলো। র্যাবের সদস্যরাও প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘটনার আশপাশ থেকে সাংবাদিকদের সব সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি রয়ে গেলাম। সঙ্গে বাংলানিউজের নূরুল আমিন। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম সাদা পোশাকের দুই-তিন জন গোয়েন্দা সদস্যের সঙ্গে। মাঝে কয়েকবার পুলিশ এসে আমাদের জিজ্ঞেস করলো এই আপনারা কারা? ওরা নিজেদের পরিচয় দিলো।
2 b continued…
Nuruzzaman Labu,
Speacial Corrospondent of Bangla Tribune