তাঁর মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে যখন “বাদশা নামদার” পড়ি, তখন অনেক কথা বলার ছিল আমার। বিস্তর দাগাদাগি, মার্জিনে মন্তব্য। বইটি যে নিজের খরিদ করা নয়, স্কুল-পড়ুয়া ভাইঝির, তাও ভুলে গিয়েছিলাম। আমার এ পাঠ-প্রতিক্রিয়া খানিকটা লেখালেখির সুবাদে। হতভাগ্য মুঘল রাজকুমার, বাংলার সুবেদার শাহ সুজাকে নিয়ে সবে “ময়ূর সিংহাসন ” লিখতে বসেছি। তখনো তথ্যের জোগাড়-যন্ত্র চলছে। এক্ষেত্রে তৈমুরিদের স্মৃতিকথার বাড়া কিছু নেই। যেমন: “#বাবুরনামা”, #তুজুকই_জাহাঙ্গীরী বা গুলবদন বেগমের #হুমায়ুননামা । তৈমুর আর চেঙ্গিস আমলের রেওয়াজ-রসম ক্ষেত্রবিশেষে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত বহাল ছিল। আমি তখন মুঘল যুগ নিয়ে হালের লেখাপত্রও নাড়াচাড়া করছিলাম। #বাদশা_নামদার সেই তাগিদ থেকেই পড়া।
কিন্তু লেখকের মৃত্যু পঠনের সেই উপলব্ধিটাই কেমন বদলে দেয়। চোখের সামনে ভাসে–গাজিপুরের পিরুজালি গ্রামে লিচুতলায় সমাহিত হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। থেকে থেকে শ্রাবণের ধারাবর্ষণ। সবুজ ঘাসের কার্পেট সরিয়ে গোর খোঁড়া হয়েছে। ঠাণ্ডা কপালে স্বজনের আঙুল ছোঁয়ানো। পরকালের শান্তির জন্য দোয়াদুরুদ, পবিত্র কালাম পাঠ। লাল মাটির কবরে সাদা কাফন জড়ানো মরদেহ সযত্নে নামানো হচ্ছে…
টিভি পর্দায় লেখক-শিল্পীর মৃত মুখ বা দাফন-কাফনের খুঁটিনাটি দেখানো কতখানি সঙ্গত কে জানে। তাতে মিডিয়ার ফায়দা হলেও, মরহুমের সৃষ্টিকর্মের নিবিষ্ট পাঠে ব্যাঘাত ঘটে। আমাদের প্রিয় লেখকদের অনেকেই বিগত জমানার মানুষ। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুকে ঘিরে কোনো দগদগে স্মৃতি নেই। সবসময় মনে হয়, সামনের খোলা বইটির কাছাকাছিই তাঁরা আছেন–অনায়াসে সংলাপ বা বাহাসে জড়িয়ে যাওয়া যায়। যার অভাব বাদশা নামদার-এর দ্বিতীয় পাঠে তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল।
মুঘল সম্রাট বাদশা হুমায়ুনকে নিয়ে “বাদশা নামদার ” উপন্যাস। এর সময় পরিধি বাবুর শাহের পানিপথ বিজয় থেকে সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যু পর্যন্ত–তিরিশ বছর। প্রায় সাড়ে চার শ বছর আগেকার পটভূমি। এক্ষেত্রে লিখিত ইতিহাসই সহায়। সম্রাট হুমায়ুন নিজে স্মৃতিকথা লিখে যাননি। তবে তাঁর জীবৎকাল নানাজনের আত্মকথনে বাঙ্ময়। লেখক হুমায়ূন আহমেদ যদিও ‘নিজেকে গবেষক-লেখক প্রমাণ করার কারণ’ দেখেন নাই বলে বইতে নির্ঘণ্ট যুক্ত করেননি, তবে হুমায়ুন-ভগ্নী গুলবদন বেগমের “হুমায়ুননামা”, পানিবাহক জওহর আফতাবচীর “#তাজকিরাতুল_ওয়াকিয়াত” আর আবুল ফজলের #আকবরনামা পড়ার কথা কবুল করেছেন।[১] সেই সঙ্গে বাবুরনামাও জুড়ে দেয়া যায়।
অবশ্য তথ্যের বাহুল্যের ওপর ঐতিহাসিক উপন্যাসের উতরানো কখনোই নির্ভর করে না। তা অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর উপন্যাসের বিষয় যদি অতি চেনা কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্র হয়, তাহলে আরেক মুসিবত। পাঠক পদে পদে খুঁত ধরেন, যেন উপন্যাস নয়, ইতিহাসগ্রন্থ পাঠ করছেন। সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে ইতিহাস-বিকৃতির অভিযোগ ওঠে। কখনো কখনো ফাঁকা জায়গায়ও তোপ দাগতে দেখা যায়। যেমন বাদশা নামদার ছাপা হওয়ার পর পর বাবুর শাহের সৈন্ধব লবণ, আখের গুড়, আদা-কাঁচা মরিচের রস মেশানো কাঁচা আমের শরবত খাওয়া নিয়ে পাঠক মহলে কিছুটা গোল বেঁধেছিল। কারণ হয়তো মুঘলদের খানাপিনায় এ ঠিক লাগসই নয়। রেসেপিটাও মামুলি। বাবুর তখন পানিপথের যুদ্ধে জিতে আগ্রার দিকে আগুয়ান। সে সময় তিনি তখতে রওয়ানে বসে কাঁচা আমের শরবত খেতেই পারেন, জায়গাটা যেহেতু হিন্দুস্তান–বাদাখশান বা সমরখন্দ নয়। তখন এ অঞ্চলে আমেরও মৌসুম। বাবুরনামায় হিন্দুস্তানের যে ফলফলাদির তালিকা পেশ করা হয়েছে, তাতে বাবুর নিজ মাতৃভূমির সরদার সমতুল মেওয়া হিসেবে আমের স্বীকৃতি না দিলেও কয়েক ছত্র এ বাবদে লিখতে বাধ্য হন। এদিকে বঙ্গদেশের কলার স্বাদ ও কচি কলাপাতার সৌন্দর্যে ছিলেন পঞ্চমুখ। তবে তাল নিয়ে তালি বাজিয়েছেন বিস্তর। তাল থেকে যে তাড়ি হয়, সুরাপায়ী বাবুরশার তা নজর এড়ায়নি।
উপন্যাসে সম্রাট বাবুরের কাঁচা আমের শরবত খাওয়ার স্থান-কাল উল্লেখ না থাকলেও শাহজাদা হুমায়ুনকে যেহেতু ইব্রাহিম লোদীর কোষাগার দখলের জন্য আগ্রা পাঠানো হয়েছে, সময়টা পানিপথের পর পর ১৫২৬ সালের এপ্রিল-মে মাস, স্থান দিলি-আগ্রার মাঝামাঝি কোথাও। তখন ধুলা উড়িয়ে হুমায়ুন হাজির। হাতে রেশমি রুমাল জড়ানো জগদ্বিখ্যাত কোহিনূর হীরা, যার গায়ে রোদ পড়ে আগুন ঠিকরাচ্ছে। বিমুগ্ধ বাবুর হীরকখণ্ডটি পুত্রের হাতে ফেরত দিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘ইব্রাহিম লোদীর রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থ আমি তোমাকে উপহার দিলাম।’
কার্যত বাবুর যা করেছিলেন, এর চেয়েও বিস্ময়কর। যে কোনো কাহিনীকারের জন্য তা লুফে নেওয়ার মতো লোভনীয়। বড় বড় শরিকদের কথা না হয় বাদই দেয়া গেল। ইব্রাহিম লোদীর রাজকোষ ফাঁক করে মক্কা-মদিনার ফকির-দরবেশদের তিনি নজর পাঠিয়েছিলেন। কাবুলের তাবত মানুষ মাথাপিছু পেয়েছিল এক শাহরুখি (রৌপ্যমুদ্রা) করে উপহার। খোরাশান, কাশগড়, সমরখন্দ, ইরাকের রিশতাদার কেউ বাদ পড়েনি। কাবুলে অবস্থানরত বেগম ও আত্মীয়াদের খেদমতে জওহর, ইয়াকুত, আলমাস, দর্মদআরিদ, জমরুদ ইত্যাদি মূল্যবান পাথরে সজ্জিত সোনার থালা এবং আশরফি বোঝাই ঝুড়ি পেশ করা হয়েছিল। এসবের দীর্ঘ বয়ান দিতে গেলে কাগজের খরচ বাড়ে। পুণ্য যা হওয়ার দাতারই হয়েছে। আর সেই সুবাদে জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবুরের তকমা জোটে ‘কলন্দর’।
যাই হোক, বাদশা নামদার-এ বর্ণিত হয়েছে সেই ধুলা ওড়ানো দুপুরের (১৫২৬ সালের এপ্রিল-মে মাসের) চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ‘সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর (হুমায়ুনের) পিতার দিল্লির কোষাগার দখল করে রাজকোষের সব অর্থ নিয়ে পালিয়ে গেলেন বাদাখশানের দিকে। আগস্ট মাস, ১৫২৭।’ চব্বিশ ঘন্টা সমান সোয়া বছর! পানিপথ যুদ্ধের সন-তারিখ জানা পাঠক নির্ঘাৎ হোঁচট খাবেন। তাছাড়া সে যুগে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেই তো বিস্তর সময় গোজার হতো। এর মধ্যে আছে রানাসঙ্ঘের বিরুদ্ধে খানুয়ার যুদ্ধ। দফায় দফায় বিদ্রোহী আফগানদের দাবড়ে বেড়ানো। এর প্রত্যেকটিতে হুমায়ুন শরিক হয়েছিলেন। এ কিসিমের প্রমাদ উপন্যাসে গ্রাহ্য কিনা কে জানে। তাহলেও এই ‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে’ অসতর্ক হওয়ার ভুল। লিখে ফিরে পড়তে গেলে তা লেখকের নজরে পড়তোই। তাতে বাড়তি কিছু লেখার দরকার হতো না। কলমের খোঁচায় তিনটি শব্দের বালাই দূর হতো।
শাহজাদা হলেও রাজকোষ লুণ্ঠন যে কোনো যুগের বিচারেই গর্হিত অপরাধ। এর জন্য তখন যে মাপের সাজা বাঁধা ছিল, তাতে মায়ের কলজে শুকিয়ে যাওয়ারই কথা। তখন হুমায়ুনের মাতা মাহম বেগম ছিলেন কাবুলে। ১৫২৯ সালের জুন মাসে তিনি আগ্রা আসেন। এ হয়তো বড় কথা নয়। কিন্তু হুমায়ুনের সাজা মওকুফের জন্য আগ্রা কেল্লায় পঙ্গু ভেড়ার মতো বাবুরের পায়ে মাহমের মুখ ঘষাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়! সত্যি যে, রাজপরিবারের দুর্যোগে-সংকটে মুঘল নারীরা দূতিয়ালি করতেন। অনেক অপরাধী খড়গের তল থেকে স্কন্ধে মস্তক নিয়ে ফিরে যেতে পেরেছে তাঁদের সুপারিশ বা ধরাধরির ফলে। তবে দৌত্যের পদ্ধতি পঙ্গু ভেড়ার মতো শাহেনশার পায়ে মুখ ঘষা কিনা আমরা জানি না। এ অজানা ক্ষেত্রটির ছবি, অনুমান করি লেখকের অভিরুচি অনুযায়ীই হয়েছে। যেহেতু বঙ্কিমের মতো তাঁর কোনো এজেন্ডা ছিল না।
#রাজসিংহ উপন্যাস ফাঁদার কৈফিয়ৎসরূপ লেখক বঙ্কিম চন্দ্রের উক্তি–‘হিন্দুদিগের বাহুবলই আমার প্রতিপাদ্য। উদাহরণ-স্বরূপ আমি রাজসিংহকে লইয়াছি।’ উপন্যাসের নায়ক মেবারের মহারানা রাজসিংহ। খলনায়ক সম্রাট আওরঙ্গজেব। ‘হিন্দুদিগের বাহুবল প্রতিপাদ্য’ হলেও মুঘল হারেমে হানা দিতে বঙ্কিম কসুর করেননি। তাঁর পরিবেশনায় জেবুন্নিসা বিদ্যাবতী, স্বাধীনচেতা শাহজাদি নন; কবি, কাব্যানুরাগী, কোরানে হাফেজ, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের কিতাবখানার প্রতিষ্ঠাত্রীও ছিলেন না। তিনি বিয়েশাদি না করে ‘পিতৃস্বসাদিগের ন্যায় বসন্তের ভ্রমরের মতো পুষ্পে পুষ্পে মধুপান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। পিসী ভাইঝি (রোশনআরা, জেবুন্নিসা) উভয়ে অনেক স্থলেই, মদন-মন্দিরে প্রতিযোগিনী হইয়া দাঁড়াইতেন।’ এহেন গীবত গাওয়ার পেছনে বঙ্কিমের অভিপ্রায়–স্বামীর চিতায় পুড়ে সতী হওয়া রাজপুত নারীদের তুলনায় মুঘল জেনানারা মহা কামুক, পাপ আর পঙ্কিলতায় ডুবে থাকা নরকের কীট বিশেষ–তা বলে বলে পাঠক ভজানো। এ ক্ষেত্রে তিনি ইতালীয়ান পরিব্রাজক ও শল্যচিকিৎসক মানুচ্চিকেও ছাড়িয়ে যান।
বাবুর-হুমায়ুন যুগের হারেমখানা আমাদের পুরোপুরি অচেনা নয় হুমায়ুননামার সুবাদে। ছোট ছোট ঘরোয়া সংলাপ ও বর্ণনায় রাজমহিষী, রাজমাতা মাহমের একটি অনবদ্য ছবি এঁকেছেন গুলবদন। কি অসামান্য তেজ, আভিজাত্য, কর্তব্যনিষ্ঠা! আরেকজন হুমায়ুন-পত্নী বেগা বেগম, পরবর্তীকালে যিনি দিল্লিতে হুমায়ুনের মকবরা গড়েন। শাহেনশাদের সঙ্গে এ দুজনের ভিন্ন দুটি জায়গায় ভিন্ন সময়ে বোলচালের চাক্ষুষ বর্ণনা মেলে হুমায়ুননামায়। তাতে রয়েছে রক্ত হিম করা রাগী সাপের ফোঁসফোঁসানি। আন-কথা কয়ে সম্রাট হুমায়ুনকে কদাচ বিরক্ত করা যাবে না মর্মে প্রণীত মুচলেকায় সই করার সময়ও বেগা বেগম আঁকশি ছাড়েননি।
আজ অবধি মুঘল হারেম বর্ণনায় একমাত্র নির্ভরযোগ্য দলিল, যা লেখক হুমায়ূন আহমেদেরও পাঠ্যতালিকায় ছিল, সেটি গুলবদন বেগমের খণ্ডিত স্মৃতিকথা হুমায়ুননামা। সবজান্তা ইউরোপীয়ান পরিব্রাজকদের বর্ণনা অনেকাংশেই জালি। উঁচু পাচিলের বাইরে দাঁড়িয়ে অন্তপুরবাসিনীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, নয়তো মনগড়া, মুখরোচক কাহিনী ফেঁদেছেন অবিবাহিত শাহজাদিদের নিয়ে। তাঁদের দর্পণে প্রাচ্যের রাজ-রাজাদের পত্নী-উপপত্নীতে ভর-ভরন্ত হারেমখানা যেন অনিঃশেষ ফুর্তিখানা, মৌজ করার মোক্ষম জায়গা। রাজ্যপাট চাঙ্গে তুলে রাতদিন ওখানে বুঝি মচ্ছবই চলে। (তাহলে তো আকবর বাদশার নম্বর ওয়ান অকম্মার ধাড়ি হওয়ার কথা, আবুল ফজলের মতে যার মহলে জেনানা ছিল পাঁচ হাজার!) দুঃখজনক যে, আমাদের মানসপটে এই চিত্রই পাকা রঙে আঁকা হয়ে গেছে।
এর বিপরীতে হুমায়ুননামায় এক ঝাঁক ফুর্তিবাজ জেনানার হদিস মেলে। নিকটে বিপদের ঘণ্টা বাজছে, তাতে কুচ পরোয়া নেই। দীর্ঘদিন চুনার দুর্গ অবরোধ করে রাখার পর শের খাঁর সঙ্গে সন্ধি করে আগ্রায় ফিরেছেন হুমায়ুন। কেল্লা জয় নয়, শত্রুকে ঝাড়ে-বংশে নিপাত করাও হলো না, তবু সকুশলে পুত্র ফেরত এসেছেন বলে রাজমাতা মাহম বেগম বিশাল উৎসবের আয়োজন করলেন। উৎসবের মধ্যমণিও জেনানারা। সেখানে দুজন মুঘল কন্যার সাক্ষাৎ মেলে, যারা বেশিরভাগ সময় পুরুষের বেশে থাকতেন। দুজনের গলায় গলায় ভাব। সেলাই ও শিল্পকর্মের পাশাপাশি এরা মল্লযুদ্ধ, তীরনিক্ষেপেও ছিলেন পারদর্শী।
এ রাজনন্দিনীরা জীবনটা জুয়ার দানের মতোই নিয়েছিলেন। দক্ষিণে বাহাদুর শাহ, বিহার অঞ্চলে শের খাঁর উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি, তাদের রোশন-জশনে ছায়া ফেলতে পারেনি। জাত দুশমন বা স্রেফ রাহাজানের হাতে লাঞ্ছিত হওয়া, ইজ্জতের নামে পরাজিত বাপ-ভাইয়ের তরবারির কোপে মৃত্যু, বিজয়ী রাজার হারেমে স্থানান্তর–এসব তখন আকছার ঘটছে। চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুনের দুই পত্নী আর ছ’বছর বয়সী কন্যা হারিয়ে গিয়েছিল। বাস্তবিক ওদের আর খোঁজ মেলেনি। সমরখন্দ থেকে বাবুর শাহ যখন বিতাড়িত হন, তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভগ্নী খানজাদা বেগম শয়বানি খানের হাতে পড়েন। বছর দশেক তাঁকে থাকতে হয়েছিল দখলদার এই উজবেগ নেতার হারেমে। সুখ-বিলাসের এমন তাশের ঘরেই বেগম-শাহজাদিদের বাস। বুকের বলও তাই সাংঘাতিক। কাবুল দুর্গ নিয়ে যখন কামরান আর হুমায়ূনের যুদ্ধ চলছে–তখন নাকি এঁরা ছাদে দাঁড়িয়ে এর মহড়া দেখছিলেন।
বাদশা হুমায়ুনের তখন সুদিন। পারস্যের নির্বাসন শেষে কান্দাহার-কাবুল ফের দখলে এসে গেছে। এরপর বলখ অভিযানের পথে হুমায়ুনের তাম্বু খাটানো হয় বাগ-এ দিলখুশা নামে এক উদ্যান-উপত্যকায়। পাহাড়-চূড়ায় রেওয়াজ ফুল ফুটেছে। তাই দেখতে ভগ্নি-বেগমসহ বাদশার সঙ্গে আরও আত্মীয়-অনাত্মীয় নারীরাও ঘোড়ার পিঠে চলেছেন। পথে প্রবহমান ঝরনা পেরোতে কেউ পিছিয়ে পড়ছে। মাহ চুচক নামে বাদশার এক বেগমের ঘোড়া আবার দিকভ্রষ্ট হয়ে উঠে গেল অনেক উঁচুতে। স্বয়ং বাদশা এক ফাঁকে খানিকটা আফিম সেবন করে ফের কাফেলায় শামিল হলেন। এভাবে আধা পথেই দিন শেষ। জ্যোৎস্না রাতে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে পাহাড় চূড়ায় ফুলের শোভা দেখতে যাচ্ছে বাদশার সহযাত্রী জেনানার দল। এমন দুর্দান্ত দৃশ্যের চকিত আভাস মেলে গুলবদনের স্মৃতিকথায়।
সম্রাট হুমায়ুনকে উৎসবে, যুদ্ধযাত্রায়, স্বল্প সময়ের অবকাশে ভগ্নি ও বেগম বেষ্টিত দেখা যায়। জেনানাদের ফুর্তি-ফার্তায় শামিল না হলেও মাতৃস্থানীয়াদের দেখভালে সম্রাট বাবুরের ত্রুটি ছিল না। হিন্দুস্তানের তখতে বসেই তৈমুর আর চেঙ্গিস বংশধরদের দরবারে ডেকে পাঠান। বারো বছর বয়স থেকে জিন্দেগিভর তিনি জঙ্গ-জেহাদই করেছেন। তাতে দফায় দফায় রক্তক্ষয় হয়েছে। এ জঙ্গে-বেউয়াদের সঙ্গে নিজ রক্তসম্পর্কের দাদি-নানি, খালা-মামি, ফুফু-চাচিসহ শতাধিক জেনানার কাফেলা পানিপথ যুদ্ধের পরপর আগ্রা পৌঁছায়। তাঁদের জন্য শাহেনশাহ আলাদা বাসস্থান আর জায়গীরের বন্দোবস্ত করেন। আগ্রার ধুলি-উড়ানো আঁধি ঝড়েও শুক্রবার শুক্রবার তাঁদের তত্ত্ব-তালাশে বের হতেন বাবুর। তবে তাঁর মদের মজলিসে, কাব্যচর্চার আসরে সঙ্গী হতেন সহযোদ্ধা পুরুষেরাই। আন্দিজানে একবার বাবুরি নামে এক কিশোরের প্রেমে দেওয়ানা হওয়ার কথা স্বয়ং বাবুর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন। আহার-নিদ্রা ঘুচে গিয়েছিল। নাঙ্গা পা, খালি মাথায় আন্দিজানের অলিগলিতে তাঁকে তখন ঘুরতে দেখা গেছে।
এ রকম উন্মত্ত ভালোবাসা, যুদ্ধে হেরে পাহাড়-কন্দরে বসবাস, সুখ-দুঃখের আরও অজস্র স্মৃতি পেছনে ফেলে আমুদরিয়ার ওপার থেকে এসেছিলেন বাবুর। এক ভাগ্যোন্নেষী অদম্য রাজকুমার। কাবুল উপত্যকায় কয়েক বছরের জন্য স্থিত হন। তিনি হিন্দুস্তান আক্রমণ করেন সাত বছরে মোট পাঁচবার। যেন মশহুর যোদ্ধা নন, আদতেই একজন নৃতাত্ত্বিক, সেইভাবে হিন্দুস্তানের ঘরবাড়ি, পোশাক-আশাক, ফুল-পাখি, জন্তু-জানোয়ার, ফল-মূল, আচার-বিচার, নদী-নালা, পথ-ঘাট, আবহাওয়া ইত্যাদির বর্ণনা দিয়েছেন বাবুরনামায়। তবে দেশটির বিশালত্ব আর সোনাদানা ছাড়া অন্য কিছু তাঁকে খুশি করতে পারেনি। এখানকার মানুষজন মনে হয়েছে বিশ্রী, মেধাহীন। মন খুলে মিশতে বা আড্ডা দিতেও জানে না। টিয়াপাখির রূপে মুগ্ধ হলেও বাবুরের কাছে এর কণ্ঠস্বর তামার পাতে চীনা-বাসন ঘষার মতো কর্কষ। ফরগানার তরমুজের জন্য আমৃত্যু তাঁর মন কেঁদেছে।
সেই তুলনায় বাদশা নামদার-এর নায়ক হুমায়ুন বাদশার জীবনের প্রথমভাগ বেশ সুস্থির। মাথার ওপর নামজাদা পিতার শাহিছত্র। তাঁর আঠারো বছর বয়সে পানিপথ। তেইশে সিংহাসনারোহন। এর আগে হিন্দুস্তানের উষ্ণ আবহাওয়ার কারণেই সম্ভবত ঘন ঘন অসুখে ভুগেছেন। প্রথম দফায় হিন্দুস্তান শাসন করেছেন দশ বছর। তখন মুঘল সম্রাজ্যের ঊষাকাল। শের খাঁর মতো প্রবল পরাক্রান্ত দুশমন গোকুলে বেড়ে উঠছে। কিন্তু সম্রাট আছেন আপন খেয়ালে। যাদের কাছে দুনিয়াদারি খোয়াব, মহাকালের কণাসম বা ছায়ামাত্র–সেই রকম আধাত্মিক চেতনাধারী তিনি ছিলেন কিছুটা। অন্যদিকে গৌড় নিবাসকালে মাথার তাজের ওপর নেকাব চড়াতেন। নেকাব সরালে মোসাহেবরা তাঁকে সোৎসাহে অভিবাদন জানাতো ‘আলোর উদয় হয়েছে!’ হিন্দুস্তান শাসনের প্রথম-পর্বে সপ্তাহের একেকদিন তিনি একেক বর্ণের পোশাক-পাগড়ি ধারণ করতেন। এ কাজে তাঁর প্রেরণা ছিল সম্ভবত কবি নিজামী গঞ্জবীর #হাফত-পায়কর কাব্যের নায়ক বাহরম গুর। সেই রাজপুরুষ সাত দেশের সাত বিবির রাশি-গ্রহ বিচার করে সাত রঙের সাতটি টুঙ্গি গড়ান। এর রঙ মিলিয়ে পোশাক পরে হপ্তার একেক দিন একেক বধূর আলয়ে হাজির হতেন। তাঁদের পরনেও থাকতো একই রঙের পোশাক। সপ্তাহের পয়লাদিন শনিবার আর এর শুরু সাদা রঙ দিয়ে। হুমায়ুনও সেই দিন সাদা পোশাক-পাগড়ি পরতেন। অন্যান্য দিনও বাহরম গুরের অনুরূপ রঙের তাঁর পোশাক ছিল। ফারাক বলতে তাঁর সাত রঙা পোশাক পরিহিত বধূ আর রঙ মেলানো টুঙ্গি ছিল না। এ রকম আরও অনেক ঘটনা, যার হয়তো সাদামাটা ব্যাখ্যা নেই, এর দেখা মেলে ইতিহাসের পাতায় আর বাদশা নামদার উপন্যাসে। এই লোকটিকেই দশ বছরের মাথায় রাজ্যহীন হয়ে জায়গায় জায়গায় ঠোকনা খেয়ে বেড়াতে হয়েছে। অপমান-নিগ্রহের শেষে সুদিন আসে আরও প্রায় পনের বছর পর। আফসোস যে, হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের পর তিনি বেশিদিন বাঁচেননি। বছর না ঘুরতেই কিতাবখানার সিঁড়ি থেকে পড়ে মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট বাদশা হুমায়ুন।
বাদশা নামদার উপন্যাসে হুমায়ুনের অপঘাতে মৃত্যুর উল্লেখ নেই, চমৎকার উপায়ে নিজের নামে নাম দূরের এক সম্রাটের বিদায়-পর্ব এঁকেছেন লেখক। এ স্বপ্ন অথবা ম্যাজিক। সম্রাট নিঃসঙ্গ নন। লেখকের প্রিয় জ্যোৎস্না পসর রাত, পাশে প্রিয় বেগম হামিদা বানু। চৌসার যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মৃত কন্যা আকিকা ও তার মৃত বান্ধবীও উপস্থিত। সম্রাটই শুধু তাদের দেখতে পাচ্ছেন। অদৃশ্য মেয়ে দুটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলে হামিদা বানু চমকে ওঠেন। বাদশা বলেন, এ হিন্দুস্তানের এক অদ্ভুত পাখি, যখন হাসে মনে হয় কিশোরী মেয়ে হাসছে। বাদশা ও বেগম সেই পাখির ডাক বা মৃত কন্যার হাসি শোনার জন্য অপেক্ষা করেন।
ইতিহাসের ঘটনা কীভাবে লেখা হলে বড় মাপের সাহিত্য হয়–এর কোনো নির্দিষ্ট তরিকা আছে বলে আমার জানা নেই। বাদশা নামদার-এর নায়ক এক রঙদার সম্রাট, যার মধ্যে বিলাসিতা-বৈরাগ্য, দয়া-নিষ্ঠুরতার মতো অজস্র বিপরীতধর্মী গুণপনা বা দোষপনার সমাহার ঘটেছে। সেই কারণে তাঁর ভোগান্তিও অশেষ। উপন্যাসে নানা কাহিনীর ভেতরে তা নিপুণভাবে চারিয়ে দেয়া হয়েছে। কখনো কখনো ঘাটতি পূরণে ব্যবহৃত হয়েছে ফুটনোট। জটিলতাহীন এর ভাষা ও বিন্যাস। পাদটিকা পড়ে নিলে অক্লেশে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিসহ ঐতিহাসিক ঘটনার পরম্পরা জানা হয়ে যায়। এই বইয়েও লক্ষণীয় যে, লেখক হুমায়ূন পাঠকের কথা ভেবে লিখেন, তাঁদের সাধ্যমতো আরাম দেন। বই-বিমুখ তরুণ-তরুণীদের বইয়ের জগতে ফেরাতে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় আর কী হতে পারে। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি সম্ভবত এইখানে। বা অন্য কোথাও। যাকে বলা যেতে পারে প্রতিভা, যা অননুকরণীয়, চেষ্টায় অর্জন হয় না। সবশেষে মনে হয়েছে, হুমায়ূন আহমেদের বই ধরে ধরে সাহিত্যিক মূল্য বিচারে বিশেষ ফায়দা নেই। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব অন্যত্র। মলাট-বন্দী কাগুজে বইয়ের কথা মানুষ ভুলে গেলেও বাংলাভাষি এ লেখককে মনে রাখবে, যার পাঠক-প্রিয়তা স্মরণাতীতকালের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল ।
Note: আলীম আজিজ ও তৈমুর রেজাকৃত হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১