১৩৬
“স্পৃটিচিউয়াল ভার্চসেস সেক্সিজম!”
“সারাজাত সৌম”
রচিত
“নুর নুর বলে চমকায় পাখি”
বইটি নিয়ে যখন আমাকে লিখতে বলা হলো তখন প্রথমেই মনে এল
‘নুর’ বিষয়ে তথা তাসাউফ, যাকে আমরা সুফিবাদ নামে সাধারণ অর্থে চিনি,
তা নিয়ে আমাদের সাহিত্যে ও শিল্পে একটি আগ্রহ হয়তো জন্ম নিয়েছে।
শিল্প ও সাহিত্যে যখন কোনো কিছু জায়গা করে নেয়
তখন তা সাধারণত পরিপার্শ্বের জীবনযাপনের অংশ থেকে আহরিত হয়,
অথবা ব্যক্তি কবি বা শিল্পীর জীবন থেকেও তা আসতে পারে।
আমাদের দেশে সুফি-ভাবনার বা মরমি-ভাবনার ইতিহাস নতুন নয়।
নানা রূপে ও দার্শনিক মতের ভেতর দিয়ে সেই ভাবনা লালিত ও চর্চিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে সেই ধারাসমূহের প্রভাব গভীর। কিন্তু এই সময়ে এসে সুফি ভাবধারার সাহিত্য ও শিল্পচর্চার নতুন কোনো তাৎপর্য আছে কিনা তা একটি প্রশ্ন বটে—প্রশ্নটি সাহিত্যের সময়, সমাজ-বিশ্বের-সভ্যতার তথা সর্বজনীন মানুষের সময়—এমন নানাবিধ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যায় এবং কেউ কেউ হয়তো একে প্রয়োজনীয়ও বিবেচনা করবেন।
গত অন্তত চার দশকে সারা বিশ্বে ধর্ম ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠী, তাদের মাঝে বণ্টিত ভূমি, ক্ষমতা ও সম্পদ নিয়ে যেসব বিবাদ, তার ফলে কট্টরপন্থার বিস্তার ঘটেছে সংক্রমণের মতো। উল্টো দিকে, হয়তো এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই, প্রশান্তি ও আশ্রয়ের খোঁজে, স্বীয় আত্মার খোঁজে, দেশ ও জাতীয়তাবাদী বিরোধ পার হয়ে বৈশ্বিক মানুষের আত্মার জিজ্ঞাসা ঠাঁই নিয়েছে প্রেমময় সুফি জবাবের কাছে। তবে সেই জবাব নতুন কিছু নয়। সেই জবাবের উৎস সমাজে বিদ্যমান ছিলই। নানা ডামডোল আসলে সেই জবাবের কাছ থেকে মানুষকে দূরে রেখেছিল বহু দিন। সাহিত্যও যে দূরে ছিল এতদিন সেই জবাব খুঁজে পাওয়া থেকে তার কারণও সমাজেই পেতে পারি আমরা।
সাহিত্য যেহেতু সর্বজনীন হতেই চায় বরাবর—বিশ্বমানবতার সাথে তার মিলনের জায়গাগুলো, মানবিক অনুভূতির কোন কোন বৈশ্বিকতায় তা সর্বজনীন, কোন কোন রুচি ও আদর্শে তা সর্বজনীন, কোন কোন অন্তর্বীক্ষণে তা সর্বজনীন এমন আরও নানা দিকে আলো ফেলা যায়।
চলুন অল্প করে দেখে নিই ভাবনা, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ও ভাবের জগতে তাৎপর্যপূর্ণ কী কী ঘটল আমাদের পৃথিবীতে এযাবৎ। চিন্তার জগতে এল ইউরোপীয় ব্যক্তিমানুষের ধারনা, এনলাইটেনমেন্ট, যুক্তিবাদ, দুইটি বিশ্বযুদ্ধোত্তর আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিক দর্শনের বিস্তার ও বিস্ফোরণ; এর সাথে যোগ হয়েছিল প্রতিশ্রুত ভূমি নিয়ে দুই জাতির দন্দ্ব/দখলদারিত্ব/প্রতিরোধ ইত্যাদির আজও পর্যন্ত চলমান সংকট; ধর্মরাষ্ট্র সৌদি আরবের জন্ম, তুর্কী সালতানাতের পতন—এই জনিত রক্তক্ষয়, সৌদি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের যাজকশ্রেণির প্রচারিত আদর্শের বিস্তার; দুই মেরুর রাজনীতি ফলস্বরূপ স্নায়ুযুদ্ধ ও পারমাণবিক ধ্বংসের হুমকি—ফলস্বরূপ উপহার পাওয়া মধ্যপ্রাচ্য-আফগান সংকট; ইরানের বিপ্লব; উত্তরাধুনিক নানা দার্শনিক মতবাদ ও প্রচলিত বহু দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মোহভঙ্গ; ধর্মীয় কট্টরপন্থাজাত সন্ত্রাসবাদ ও সেই আদর্শের প্রচার ও বিস্তার; নয়-এগারো ও তৎপরবর্তী পৃথিবীর নতুন মেরুকরণ, আরও যুদ্ধ আরও দেশ দখল ও আরও মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া; ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় কট্টরপন্থার নতুন রাজনৈতিক উত্থান ও বিস্তার; নতুন সব শক্তির উত্থান ও ধ্বংসের ভেতর দিয়ে জাগতে থাকা মিথ ও তার আধারে জমতে থাকা নানাগন্ধী বিষয়াদি।
আধুনিকতা মানুষকে একরৈখিকতা, হতাশা, ক্ষয়, প্রশ্ন করার মানসিকতা, অবিশ্বাসী দর্শনের নতুন ধারা, ইত্যাদি দিয়েছে এমন বলা যাবে না হয়তো, কিন্তু আমাদের সাহিত্যে আধুনিকতা যেসব ছাপ রেখেছে সেগুলো মোটা দাগে অনেকট ওপরে বলা লক্ষণসমষ্টিতে ধরা পড়ে। একবার বিশ্বাস হারিয়ে ফেললে তাকে ফিরে পাওয়া যেমন শক্ত, ফিরে পাওয়া বিশ্বাসকে শিল্পে ফলিয়ে তোলা কঠিনতর। কবিতায় আধুনিকতার ইউরোপীয় পিতাদের এই সংকট ছিল কিনা তা বিতর্কের বিষয়—আমার দৃষ্টিতে তা ছিল না। বোদলেয়ারের গভীর আত্মবিশ্লেষণ এবং অশুভের শরীরী ও বস্তুগত অভিব্যক্তির পাশাপাশি, শুভ-মঙ্গল ইত্যাদিতে গভীর আস্থা, ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল। আধুনিকতা যখন বাড়ছে সেই সময়ের কবি রাইনের মারিয়া রিলকে গভীরভাবে আধ্যাত্মিক ছিলেন। রনে শার-এর উল্লেখযোগ্য কবিতায় রহস্যের মূল নিহিত রয়েছে আধ্যাত্মিকতায়। টিএস এলিয়টের কবিতার বড় সুরটি এমন আত্মার, যা আহত হয় মানুষের মাঝে নীতির মৃত্যু ঘটেছে বলে। তিনি প্রাচীন সাহিত্য ও পুরাণ থেকে বীজ নেন মন্ত্রের, রহস্যের।
কিন্তু আমাদের সাহিত্যের ষাট, সত্তর, আশি বা নব্বইয়ের কবিতায় উপরে বলে আসা এই চর্চাগুলো খুব বেশি হতে দেখি নি। প্রকরণ ও ভাষা নিয়ে এখানে যেসব কাজ হয়েছে, সমাজ ও মানুষের পরাজয় নিয়ে যত কাজ হয়েছে, মানুষের মুক্তির ও শান্তির পথ হিসেবে আধ্যাত্মিকতা, রহস্য, সুফি মরমিবাদ নিয়ে ততখানি মোটেই হয় নি ব’লে আমার পর্যবেক্ষণ বলে। উত্তরাধুনিকতাবাদ যখন এই দেশের সাহিত্যে চর্চিত হতে শুরু করল তার যে অভিব্যক্তি তা অনেকের অনুভবে ছিল বিপর্যয়ের। তার সাথে যুক্ত ছিল উত্তর-উপনিবেশবাদী নানা প্রশ্ন ও সংকট। সেখান থেকে কেউ কেউ মাটির কাছে তথা বাংলার শিকড়ের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন বটে—সেসব প্রচেষ্টা ভঙ্গিতে তথা ভাষার উপরিতলে যতটা পরিলক্ষিত হয়েছে, মননের ও নন্দনের গভীরে ততখানি পৌঁছে নি। কারও কারও বেলায় তা কেবলই অভিব্যক্তির ভিন্নতায় বা বৈচিত্র্যে পর্যবসিত হয়েছে, কারও কারও অভিব্যক্তি একটি মেকি চর্চায়ও মরেছে। কিন্তু শেষ অবধি কেউ কেউ মরমি জিজ্ঞাসায় আন্তরিক দৃষ্টি দেবেনই এমন সময়ের প্রতীক্ষা ছিল অনেকেরই। সম্ভবত সেই সময় হয়েছে, এবং লেখকদের কেউ কেউ সেই দিকে চোখ ফেরাচ্ছেন শিল্পিতভাবেই। সারাজাত সৌম-র শিল্পচেষ্টাকে সেই নিরিখে দেখতে চাই আমি।
প্রচলিত ও পরিচিত সুফিচিন্তা যেসব বিষয়ে আলো ফেলে সেগুলো মোটা দাগে কী কী, চলুন দেখে নিই। আত্মবীক্ষণ, নিজকে চিনবার চেষ্টা করা, মানুষকে প্রাধান্য দেয়া এবং মানুষের মাঝে পরমকে খুঁজতে চাইবার, বৈশ্বিক তথা বিশ্বব্যাপী নানা রূপে প্রবাহিত প্রাণসমূহের মাঝে একটি মূল সত্তাকে বুঝতে ও ধরতে চেষ্টা করা, প্রাণের বিবিধ রূপবৈচিত্র্যের মাঝে বৈশ্বিক মহাশক্তির প্রেমময় উপস্থিতিকে বুঝতে চাইবার ও সেই মহা-অস্তিত্বে নিজেকে বিলীন করার প্রবণতা প্রধান। সুফিসাহিত্য গত কম-বেশি নয়শত বছরে নানারকম মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে যেসব প্রবণতাসমূহকে ধরতে পেরেছে তার অবয়ব অনেকটা এমনই। সুফিসাহিত্যের ও লেখালেখির কিছু উল্লেখযোগ্য নাম—ইবনে আরাবী, জালাল আল দ্বীন রুমী, ফরিদ আল দ্বীন আত্তার, শায়খ সাদী—এই প্রবণতাসমূহের মাঝেই মূল্যায়িত হয়েছেন। আমাদের দেশে বাউল ধারার মরমি সাহিত্যে লালন সাঁই সম্ভবত খ্যাতির দিক থেকে শীর্ষে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মরমি প্রেমভাবনা ও উপলব্ধি আমাদের অনেক দিয়েছে। সারাজাত সৌম-র বই নুর নুর বলে চমকায় পাখি এই কবিদের ধারায় বাহিত প্রবণতাগুলোকে ছুঁয়ে যেতে চেয়েছে বলে প্রতীয়মান। সারাজাত সৌম সুফিতত্ত্বের গভীরতাকে ধরার চেষ্টার তুলনায় সুফি আবহকে ঘিরে শিল্পকে অর্থাৎ তার কবিতাকে ফলিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
মরমি ভাবনা যেহেতু এই মাটির মানুষের সহজাত, কাজেই সেই ভাবনার রস যখন কবিতায় জারিত হয়, সেই ভাষাকে সহজ বলে অনুভূত হয়। তবু কিছু মরমি ভাবনার আকর সেখানে বিশিষ্ট হয়েই ধরা পড়ে। যদি জিজ্ঞাসা করি বইয়ের শিরোনাম নুর নুর বলে চমকায় পাখি কেন হলো, তাহলে সারাজাত সৌমের কবিজিজ্ঞাসারও ভেতরে যাওয়া সহজ হবে বলে মনে করি। নুর, যাকে সাধারণ অর্থে আলো বলে অনুবাদ করা হয়ে থাকে, তা ইসলামি মরমি ভাবনায় জগৎসৃষ্টির মৌল বলে চিহ্নিত। উপরন্তু পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে আল্লাহ নিজেকে বলেছেন ‘আকাশ ও ভূমির নুর’। কাজেই সারাজাত সৌমের পাখি ‘নুর নুর’ ব’লে যিকির করে। এই পাখিকে যদি ফরিদ আল দ্বীন আত্তারের পাখি-সমাবেশের পাখিদের সাথে মিলিয়ে দেখি তবে বুঝব যে, বস্তুত কবির আত্মা নিজেই নুর নুর ব’লে যিকির করে, তথা নুরকে স্মরণ করে, সন্ধান করে এবং দেখতেও পায়।
কবি হিশেবে এই বইতে সারাজাত সৌমর অন্বেষা দেখতে পায় স্বতন্ত্র সব অস্তিত্ব, প্রকৃতিতে মানুষের ও অন্য জীবের সত্তাপরিক্রমা—যাকে দৃশ্যের নিরিখে কবি সৌন্দর্য বলে চিহ্নিত করেন। কবির আত্মা যেন পাখির চোখে দেখছে, উড়তে উড়তে দেখছে জগৎকে। এই দেখা অনঙ্গ হয়ে দেখা, শরীর অতিক্রম করতে করতে দেখা। সামূহিক অবচেতন থেকে স্মৃতির উপরিতলে ভেসে ওঠা। ঘুমন্ত গীতের সুর থেকে জাগছে সামুহিক অবচেতন, কবিতা ও সত্তার স্মৃতি।
জলের নিচে ডুবে গিয়ে মিথ—
মাটির গভীরে ঘুমিয়ে পড়েছে আজ
হারানো সেইসব সোনার গীত
[গীত,পৃ. ২২
মরমি সত্তা দেখতে চায় দৃশ্য ও দৃশ্যের গভীরে, যাতে আপাত চাক্ষুষ-বাস্তবতার খোলসের নিচে তার রূপবদল এবং রূপ কেমন করে বৈচিত্র্যের আবরণে আশ্রয় নেয় তাও দেখা যায়। একটি গোলাপের অবয়বে সৃষ্টির ধাঁধা ও জবাব প্রেম দিয়ে বুঝিয়েছেন কবি—
আমিও কি ধাঁধা নই—
সমস্ত ইশকের মতো, একটি গোলাপ
[ধাঁধা, পৃ. ২৭
সুফির চোখ দিয়ে দেখেন বলেই কবি অনুভব করেন, বিশ্বাসের গভীর থেকে যে শব্দ ও ধ্বনির গভীরে বিরাজ করে বাস্তব এবং অস্তিত্ব। ভাষা কিভাবে প্রবাহিত হয় জনপদে। ভাষা কেমন করে তৈরি হয় স্মৃতি থেকে, স্মৃতির ধ্বনি থেকে ভাষা—
সে এক হাওয়ার দেশ–
পাখির চোখের নিচে ঘুরে ঘুরে সারাদিন
কেবলই ডুমুরের দিকেই পা বাড়ায়।
[ভাষা, পৃ. ২০
কবি আবিষ্কার করেন বিলীনতার অর্থ। সুফি-বিশ্বাসে মহাবিশ্বের মূল বস্তু নুর থেকে তথা মূল সারাৎসার বা মূল সত্তা থেকে ছায়াজগতের সৃজন।
আমাকে ভাবো–
যেভাবে কিরণ পাতায় লাফিয়ে পড়ে
আর বানাতে থাকে একেকটি গাছের ছায়া শারীরিক
[কিরণ, পৃ. ২৬
জালাল আল দ্বীন রুমীর ভক্তগণ তাঁর কবিতার যেসব অনুবাদ ও মূল্যায়ন করেছেন তার মাঝে সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় ভাবনাটি হলো—বিশ্বের সবকিছুর মাঝে নিজের সত্তাকে দেখা। কেবল নিজেকে ঈশ্বরে বিলীন দেখে সে। মানবতা-অতিক্রান্ত মানুষ খুঁজে পাওয়া—সহজ মানুষ, মানুষ ভজো।
বারবার দেখার পর মনে হলো—
আমিই ছিলাম বারবার
এই ঋতুর—ঋতুহীন বনে
[আলপিন, পৃ. ৪৮
প্রেমিক ভাবে যে প্রেমাস্পদ, সে তারই; কেননা সুফি বচনে আছে—নিগূঢ়ভাবে ভাবলে দেখবে প্রেম, প্রেমিক, প্রেমাস্পদ সবই এক। তবু নিবিড় ও নিগূঢ়ভাবে ভাবার জন্য সত্তা নিজেকে পৃথক রাখে। কেননা, মোল্লা আলী কারীর মতো প্রেমিকসাধু বলেছিলেন যে ঈশ্বর বলেছেন, ‘আমি ছিলাম গুপ্ত ধনভাণ্ডার। আমি চেয়েছি আমাকে চেনা হোক। কাজেই, আমি সৃষ্টিকে সৃজন করলাম।’ (আগ্রহী পাঠক দেখতে পারেন : কুনতু কানজান মাখফিয়ান…)। সৌম সেই বোধিকে ব্যক্ত করেন এভাবে :
দূরে ধ্বনির মগ্নতায় এ কি—
অগণিত পাগল
যেন এক আল্লাহ তার—
প্রেমের ভেতর ডুবে যাচ্ছে বিনা বাধায়।
[ধাঁধা, পৃ. ২৭
আমাদের জানাশোনা সুফিচর্চার বিষয়গুলো, যেমন প্রেম, সোহবত, সামা, ইত্যাদি বাদ যায় না সৌমর কবিতায়। কুশলী পথে তিনি ‘কুন ফা ইয়া কুন’-এর শব্দব্রহ্মকেও প্রকাশ করে দেন। বিলীনতা-লাভ তথা ফানা হবার যে সাধ লালন করেন মরমি সাধক, তার সেই সাধনায় কাজ করে অহম ও আমিত্বের খোলস থেকে মুক্তিলাভের আপ্রাণ চেষ্টা। সৌম সেই খোলসকে কথার ধারায় ঝরিয়ে দিচ্ছেন :
এখানে মূলত আমি নাই—
ওগো, তুমি কেমন মেয়ে
আসলে তুমিও তো নাই—
দ্যাখো, নিজ সমস্তটা খুলে
[কী, পৃ. ৩৩
মৃত্যু, নশ্বরতা, ইমেইজের জগৎ, প্রতিফলনের জগৎকে চারপাশে আবিষ্কার করেন সৌম। রূপ পরিবর্তনশীল, কেননা ক্বলব ব’লে যে পরিচিত উপাদান নিজেদের মাঝে আছে ব’লে আমরা জানি, তা পরিবর্তনশীল।
জলতলে চিহ্ন
আছে যেন সকলের—
মানুষেরা ভিন্ন
একেকটি কলবের।
[নুর নুর বলে চমকায় পাখি, পৃ. ৬০
‘নুর নুর বলে চমকায় পাখি’ কবিতায় নুর নুর ব’লে ধুন পরিবর্তিত করার অর্থ ও উদ্দেশ্য কেবল ধুন তৈরি করার মতো কাব্যিক নয়, বরং জগতে ও নিজের অস্তিত্বে নুর-এর অনিবার্যতাকে স্পষ্ট করে তোলা। হালকা চালে ছুঁয়ে যাওয়া সুফিনৃত্যের ধারনাকে কবিতার পদে দেখি—
পাতাটির ধ্যান থেকে উড়ে গিয়ে
একটি পাখির ডাক দিলে তুমি—
যেন দূর সাইরেন থেকে বেজে
উঠে তার—উত্তাপ ছড়ানো রুমি
[নুর নুর বলে চমকায় পাখি, পৃ. ৬০
এই পাখি অনেকটা ফরিদ আল দ্বীন আত্তারের ‘মানতিক আত তাইর’-এর পাখিসভার আত্মজিজ্ঞাসু পাখি, যে নিজের নফসকে আবিষ্কার করে, নিজেকে দেখতে পায়। কেননা সুফিবিশ্বাসের মৌল আরেক ধ্বনি—’যে নিজেকে চিনেছে সে ঈশ্বরকে চিনেছে’—
ওখানে তুমি কি নও উৎসমূলে
বিঁধে থাকা এমন হাজারো পাখি—
নুর নুর বলে নেয় তুলে
যারা মুগ্ধতার পাপ ও পানোখী…
[নুর নুর বলে চমকায় পাখি, পৃ. ৬০
সারাজাত সৌম-র ভাষা দেয়াল তৈরি করে না, ঘোমটা তৈরি করে। কিন্তু কোনো ঘোমটাই তো প্রেম তৈরি হতে বাধা দেয় না। ছায়াসত্তা বিলীন হতে চায় বলে আড়াল হতে চায়। হারাতে চায়, এবং এই কারণে ভাষাতে তার প্রতিফলন ঘটে। সৌমের ভাষা নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ তৈরি হয়েছে, আমার তা হলো—এত এত প্রতিফলনের যে ভাষ্য পাচ্ছি আমরা তা সমসাময়িক কবিতার ইমেইজের ধারার বাইরে হলেও এই ভাষা সেই ধারার একটি চরিত্র ধরে রেখেছে, তা হলো, এই ভাষা স্রোতের মতো, চলমান, স্থিরতার ধার ততটা ধারছে না। অর্থাৎ যে প্রতিফলন ঘটছে তার বিম্বের সামনে কবি দাঁড়াচ্ছেন বলে মনে হয় না। এর পেছনে যে অবচেতন কাজ করতে পারে বলে আমার বিশ্লেষণ বলছে, কবি ধাবমান মহাকালে পেরিয়ে মহাসত্তা তথা পরম-এর দিকে এগুচ্ছেন বা পাঠককে নিয়ে যেতে চাইছেন—এমন বোধ তৈরি করার প্রচেষ্টা আছে কবির। অন্তত এমন আভাস দিতে চায় এই ভাষা। বিম্বের সামনে না দাঁড়ানোতে আত্মবীক্ষণ জন্মাচ্ছে না এমন বলা যায় না। আত্মবীক্ষণ আছে বলেই ব্যঞ্জনা তৈরি করছে শব্দ। অপস্রিয়মাণতাই কবিতার নশ্বরতা এমন প্রস্তাব করা যাবে না। জগৎ অপস্রিয়মাণ হলে তার অভিব্যক্তি অপস্রিয়মাণ হতে পারে বটে। উপরন্তু কবি যে গান দিয়ে গেলেন তা যদি পাঠককে ফানা হবার স্বাদ নিতে আগ্রহী করতে চায়, তবে সেই চেষ্টাকে আমাদের মন দিয়ে বুঝতে চাওয়াই উচিত।
নোট:
মাঝে মাঝে
“কপি-পেস্ট”
কাব্য-মহাকাব্য
এড করতে খারাপ লাগে না!